ইতিহাস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ইতিহাস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

রবিবার, ৩ জুলাই, ২০২২

ষোড়শ মহাজনপদের বিভিন্ন রাজ্যগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও । মহাজনপদগুলির মধ্যে মগধের উত্থানের প্রধান কারণগুলি কী ছিল ?

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer ষোড়শ মহাজনপদের বিভিন্ন রাজ্যগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও মহাজনপদগুলির মধ্যে মগধের উত্থানের প্রধান কারণগুলি কী ছিল shorosh mohajonpoder bivinno rajjogulir songkhipto porichoy dao


উত্তর : ষোড়শ মহাজনপদের রাজ্যগুলির অবস্থান ছিল আফগানিস্তানের কাবুল থেকে দক্ষিণ ভারতে গােদাবরী নদীর উপকূলের মধ্যবর্তী অঞ্চলে । রাজ্যগুলি হল—  
কাশী : এর অবস্থান ছিল বর্তমান উত্তরপ্রদেশের পূর্বদিক । 

কৌশল : এর অবস্থান ছিল বর্তমান অযােধ্যা বা শ্রাবস্তী । 

অঙ্গ : এর অবস্থান ছিল বর্তমান পূর্ব বিহার । এই রাজ্যের রাজধানী ছিল চম্পা ।

মগধ : মগধের অবস্থান ছিল বর্তমান বিহারের গয়া ও পাটনা জেলা । এর প্রথম রাজধানী ছিল গিরিব্রজ বা রাজগৃহ । পরে পাটলিপুত্রে রাজধানী স্থানান্তরিত হয় । 

অবন্তী : এর অবস্থান ছিল বর্তমান মালব ও মধ্যপ্রদেশের কিছু অংশে । এর উত্তরাংশের রাজধানী ছিল উজ্জয়িনী ও দক্ষিণাংশের রাজধানী ছিল মাহিস্মৃতি । 

বৎস : এর অবস্থান ছিল বর্তমান এলাহাবাদের নিকটবর্তী গঙ্গার দক্ষিণ তীরে । এর রাজধানী ছিল কৌশাম্বী । 

বৃজি : এর অবস্থান ছিল বর্তমান উত্তর বিহারে । এর রাজধানী ছিল বৈশালী । 

মল্ল : এর অবস্থান ছিল বর্তমান উত্তরপ্রদেশের গােরক্ষপুর জেলা । এর রাজধানী ছিল কুশীনগর বা পাবা । 

কুরু : এর অবস্থান ছিল বর্তমান দিল্লি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল । এর রাজধানী ছিল ইন্দ্রপ্রস্থ ।  

পাঞ্চাল : এর অবস্থান ছিল বর্তমান রােহিলখণ্ড । উত্তর পাঞ্চালের রাজধানী ছিল অহিচ্ছত্র এবং দক্ষিণ পাঞ্চালের রাজধানী ছিল কাস্পিল্য ।  

চেদি : এর অবস্থান ছিল বর্তমান বুন্দেলখণ্ড ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল । এর রাজধানী ছিল শুকতিমতী ।  

মৎস্য : এর অবস্থান ছিল বর্তমান রাজপুতানার জয়পুর । এর রাজধানী ছিল বিরাটনগর ।  

শূরসেন : এর অবস্থান ছিল যমুনা নদীর তীরে মথুরা অঞ্চল । এর রাজধানী ছিল মথুরা । 

অম্মক : এর অবস্থান ছিল বর্তমান গােদাবরীর উপত্যকা অঞ্চল বা পাটলি । এর রাজধানী ছিল পােটালি বা পােটান । 

গান্ধার : এর অবস্থান ছিল বর্তমান রাওয়ালপিণ্ডি ও কাশ্মীর উপত্যকা । এর রাজধানী ছিল তক্ষশিলা । 

কম্বোজ :এর অবস্থান ছিল বর্তমান দক্ষিণ -পশ্চিম কাশ্মীর । এর রাজধানী ছিল রাজপুর । 

[       ]  প্রথমদিকে ষোড়শ মহাজনপদের রাজ্যগুলির মধ্যে অবন্তী , বৎস , কোশল এবং মগধ — এই চারটি রাজ্য প্রাধান্য লাভ করেছিল । অবশেষে হর্ষঙ্ক , শৈশুনাগ , নন্দ ও মৌর্য —এই চারটি রাজবংশের আমলে মগধকে কেন্দ্র করে উত্তর ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় । 


সুযােগ্য নেতৃত্ব : হর্ষঙ্ক বংশের বিম্বিসার , অজাতশত্রু , শৈশুনাগ বংশের শিশুনাগ , নন্দ বংশের মহাপদ্মনন্দ , মৌর্য বংশের চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, অশােক প্রমুখ রাজন্যবর্গের দক্ষ নেতৃত্বে মগধের সাম্রাজ্য সফলভাবে পরিচালিত হয়েছিল । মগধের বাসসাকর , কৌটিল্য , রাধাগুপ্ত প্রমুখ মন্ত্রীবর্গের সুযােগ্য পরামর্শও এবিষয়ে যথেষ্ট সহায়তা করেছিল ।


বিদেশি আক্রমণ থেকে রক্ষা : মগধের অবস্থান ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের উপদ্রুত অঞ্চল থেকে অনেক দূরে হওয়ায় বিদেশি আক্রমণকারীদের পক্ষে ভারতের অভ্যন্তরে এত দূরে আক্রমণ করা সহজ ছিল না । 

ভৌগােলিক অবস্থান : মগধ রাজ্য ও রাজধানী নদী ও পাহাড়ের দ্বারা বেষ্টিত ছিল । মগধের প্রথম রাজধানী রাজগৃহ ছিল পাহাড়বেষ্টিত । পরবর্তী রাজধানী পাটলিপুত্র গঙ্গা, শোন ও গণ্ডক নদীবেষ্টিত হয়ে যেন এক ‘জলদুর্গে’ পরিণত হয়েছিল । এরুপ ভৌগােলিক নিরাপত্তা ভেদ করে শত্রুদের পক্ষে মগধ আক্রমণ করা সহজ কাজ ছিল না । 


উর্বর কৃষিজমি : গঙ্গা ও অন্যান্য নদী বিধৌত মগধের কৃষিজমি ছিল খুবই উর্বর । কৃষিতে প্রচুর উৎপাদনের ফলে প্রভূত পরিমাণ রাজস্ব আদায় সম্ভব হত । ফলে মগধে সৈন্যদের ভরণ পােষণে সুবিধা ও রাজকোশের আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটেছিল ।


বৈদেশিক বাণিজ্য : বিভিন্ন দূর দেশের সঙ্গে মগধের রপ্তানি বাণিজ্য চলত । মগধের সমৃদ্ধ বৈদেশিক বাণিজ্যের ফলে সেখানকার অর্থনীতি মজবুত হয়েছিল । এই আর্থিক শক্তি মগধের সামরিক শক্তির ভিতও শক্ত করেছিল । 


অরণ্য সম্পদ : মগধের ঘন অরণ্য ছিল হিংস্র জীবজন্তু ও অসংখ্য বৃক্ষে পরিপূর্ণ । এইসব বৃক্ষের কাঠ যুদ্ধ প্রকরণে কাজে লাগত । এ ছাড়া এই অরণ্য থেকেই মগধের সৈন্যের যুদ্ধের জন্য প্রয়ােজনীয় রণহস্তী সংগ্রহ করা হত । 

খনিজ সম্পদ : মগধের তামা ও লােহার খনিগুলি সামরিক অস্ত্রশস্ত্র ও কৃষির জন্য প্রয়ােজনীয় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরিতে ব্যবহৃত হত । ফলে মগধের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষিরও উন্নতি হয়েছিল । 


মিশ্র সংস্কৃতি : মগধের সীমানার একদিকে আর্য ও অন্যদিকে অনার্য সংস্কৃতির অবস্থান থাকায় এখানে এক মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে ওঠে , যা মগধের অগ্রগতিকে সহজ করেছিল । 


উপসংহার : খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ষােলােটি মহাজনপদ গড়ে উঠলেও সাম্রাজ্য গড়ে তােলার মতাে প্রয়ােজনীয় উপাদান সব মহাজনপদের ছিল না । তবে মগধ মহাজনপদটি ছিল এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী । তাই নিরাপদ ভৌগােলিক অবস্থান ,সুযােগ্য নেতৃত্ব,প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য প্রভৃতি নানা উপাদানকে কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত মগধ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে নিজের উত্থানকে সুনিশ্চিত করে ।






শনিবার, ২ জুলাই, ২০২২

পলিস বা নগর রাষ্ট্র কী ? পলিসের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো ।

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer পলিস বা নগর রাষ্ট্র কী পলিসের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো polish ba nogor rastro ki polisher boishistoguli lekho


উত্তর : গ্রিক ভাষায় ‘ পলিস ’ শব্দটির দ্বারা ‘নগর’ এবং ‘রাষ্ট্র’ উভয়কেই বােঝানাে হয়ে থাকে । 

i) নগর : পলিসকে এই অর্থে ‘নগর’ বলা হয় যে, এখানে সকল পলিসবাসীর জন্য বাজার এবং নাগরিকদের সমবেত হওয়ার জায়গা থাকত । 


ii) রাষ্ট্র : ‘পলিস’ কে ‘রাষ্ট্র’ বলার কারণ হল , রাজকীয় কাজকর্ম , প্রশাসন পরিচালনা , বিচারকার্য সব এখান থেকেই পরিচালনা করা হত । অধ্যাপক কিটো বলেছেন যে, সাধারণ পলিস ঠিক শহরের মতাে ছিল না ,আবার তা রাষ্ট্রের চেয়েও বেশি কিছু ছিল । 



[      ] ভূখণ্ডের জনসমষ্টি : ‘পলিস' বলতে নির্দিষ্ট ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মরত একটি জনগােষ্ঠীকে বােঝাত । প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসবিদ থুকিডিডিস বলেছেন , “Men are the polis” , ‘ অ্যাকারনিয়াস ’ নাটকের একটি উক্তি— “হে পলিস তুমি দেখতে পাচ্ছ ;” কিংবা ‘অয়দিপাউস’ নাটকের “আমি একা নয়, সমগ্র পলিস শুনেছে” —এই উক্তিটির দ্বারাও বােঝা যায় যে এখানে ‘পলিস ’ বলতে সেই ভূখণ্ডের সমগ্র জনগােষ্ঠীকেই উল্লেখ করা হয়েছে । 


[        ] রাজনৈতিক ভিত্তি : প্রাচীন গ্রিক পলিসগুলির একটি রাজনৈতিক ভিত্তি থাকত । যেমন — আরকাডির মতাে গ্রিক সম্প্রদায়ের কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান না থাকায় তারা পলিস বলে গণ্য হত না । তাছাড়া কোনাে অগ্রিক রাষ্ট্র সম্পর্কে ‘পলিস’ শব্দটি ব্যবহার করা হত না । 


[         ] নাগরিক জীবনের সুবিধা : পলিসগুলিতে বড়াে বাড়ি, জিমনাসিয়াম , প্রেক্ষাগৃহ, বাজার প্রভৃতি নাগরিক জীবনের বিশেষ সুযােগসুবিধা থাকত । এই সুযােগসুবিধা না থাকায় পােনােসিয়াস নামক মধ্য গ্রিসের ছােটো শহরটিকে ঐতিহাসিক পেটসেনিয়াস ‘নগর রাষ্ট্র’ বলতে রাজি নন । অ্যারিস্টটলও তার ‘পলিটিক্স’গ্রন্থে – [ i] স্বাস্থ্য , [ ii ]প্রতিরক্ষা,[iii] রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ এবং [ iv ] সৌন্দর্য — এই চারটি বিষয়কে নগর রাষ্ট্রের পরিকল্পনায় আবশ্যিক বলে উল্লেখ করেছেন । 

[         ]  খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম থেকে চতুর্থ শতকে গ্রিসের ধ্রুপদি যুগে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্র বা পলিসগুলির উদ্ভব হয় । এগুলির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় । যেমন – 


ক্ষুদ্রায়তন ও অল্প জনসংখ্যা : গ্রিক পলিসগুলির আয়তন হত খুব ছােটো এবং জনসংখ্যা ছিল খুব কম । অ্যারিস্টটল তার ‘পলিটিক্স’ গ্রন্থে পলিসের আয়তন ক্ষুদ্র হওয়ার কথা বলেছেন । প্লেটো তার ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে বলেছেন যে , একটি আদর্শ পলিসের লােকসংখ্যা হওয়া উচিত ৫০০০ । আসলে এখানে জনসংখ্যা এমন একটা পর্যায়ে থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল যাতে প্রত্যেকেই প্রত্যেককে চিনতে ও জানতে পারে । 

নগর ও গ্রামের সমন্বয় : গ্রিসে পলিস বলতে শুধু ‘নগর -রাষ্ট্র’ ছিল না । সেখানে এথেন্সের মতাে কয়েকটি উন্নত নগরকেন্দ্রিক পলিস ছিল , আবার স্পার্টার মতাে বহু পলিস ছিল যেখানে মানুষ গ্রামে বসবাস করত । আবার অনেক পলিসে নগর ও গ্রাম উভয়ই ছিল ।  


জনগণের প্রশাসন : গ্রিক পলিসগুলির শাসন পরিচালনায় জনগণ প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করত । উল্লেখ্য যে , পলিসের প্রশাসনিক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারত শুধুমাত্র নাগরিকরা । বিদেশি ক্রীতদাস ও মহিলারা এই অধিকার পেত না । 


 শাসনকাঠামাে : গ্রিসের পলিসগুলিতে গণতান্ত্রিক, অভিজাত তান্ত্রিক , স্বৈরতান্ত্রিক প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের শাসনকাঠামাে চালু ছিল । পলিসের শাসনকাঠামাের প্রধান তিনটি অংশ ছিল , যথা— [i] সমিতি , [ ii ]পরিষদ ও [ iii] ম্যাজিস্ট্রেট । 
 
গঠন বিন্যাস : প্রতিটি পলিসের নির্দিষ্ট গঠনকাঠামাে ছিল । যেমন — পাহাড়ের শিখরে থাকত শাসনকেন্দ্র বা অ্যাক্রোপলিস ; অধিকাংশ পলিসে থাকত জনসাধারণের জন্য বাজার বা অ্যাগােরা । আর ছিল নগর -প্রাচীরের বাইরে চোরা বা গ্রামীণ অঞ্চল । 


 অর্থনৈতিক বৈষম্য : গ্রিসের বিভিন্ন পলিসে বিভিন্ন ধরনের বিকাশ ঘটেছিল । করিন্থের মতাে কোনাে কোনাে পলিস ছিল শিল্প বাণিজ্যে উন্নত , আবার স্পার্টার মতাে পলিসগুলির মানুষ কৃষি বা মন্দিরের আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল । এর ফলে গ্রিসের পলিসগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি হয়েছিল । 
 
স্বাতন্ত্র্য : প্রতিটি গ্রিক পলিস ছিল স্বাধীন,স্বশাসিত এবং একে অপরের থেকে পৃথক । প্রতিটি পলিসেরই নিজস্ব সরকার , সেনাবাহিনী ও ক্যালেন্ডার থাকত । সম্ভবত পলিসগুলির প্রতিটির পৃথক মুদ্রাব্যবস্থা এবং মানচিত্র ছিল । কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে পলিসগুলির পূজাপদ্ধতিও পৃথক হত । 

উপসংহার : আনুমানিক ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসে ডােরিয়ান বিজয়ের পরবর্তীকালে বিভিন্ন নগরকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পলিস গড়ে উঠতে থাকে । খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে সপ্তম শতকের মধ্যে পলিসগুলি তাদের প্রাথমিক রূপ লাভ করে । প্রথম দিকে ‘পলিস ’ ছিল মূলত গ্রিসের নগর দুর্গ । পরবর্তীকালে গােটা রাষ্ট্র , রাষ্ট্রের মানুষ ও তাদের সংস্কৃতি পলিসের সমার্থক হয়ে ওঠে ।



শুক্রবার, ১ জুলাই, ২০২২

সুমেরীয় সভ্যতার নগর পরিকল্পনা ও জীবনযাত্রা কেমন ছিল ?

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer সুমেরীয় সভ্যতার নগর পরিকল্পনা ও জীবনযাত্রা কেমন ছিল sumeriyo sobhotar nogor porikolpona o jibonyatra kemon chilo

উত্তর : সুমেরীয় সভ্যতার নগর পরিকল্পনা ।

[      ] নির্মাণ পরিকল্পনা : সুমেরীয় সভ্যতার বিভিন্ন নগর ও জনপদগুলি সুনির্দিষ্টভাবে এবং পরিকল্পনামাফিক নির্মিত হয়েছিল । এক একটি জনপদে অসংখ্য বাড়ি,মন্দির ও রাস্তাঘাট নির্মিত হত । উর , উরুক ,লাগাস , কিশ , এরিডু , আক্কাদ প্রভৃতি শহরে খননকার্য চালিয়ে এই সভ্যতার নগরপরিকল্পনা সম্পর্কে বহু তথ্য জানা গেছে । 


[         ] নগরের নিরাপত্তা : সুমেরের বিভিন্ন নগরের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ লেগে থাকত । তাই সুরক্ষার উদ্দেশ্যে নগরগুলি উঁচু প্রাচীর ও চওড়া খাল দিয়ে ঘেরা থাকত । তা ছাড়া নগরগুলিতে সর্বদা সৈন্যবাহিনীর পাহারার ব্যবস্থা ছিল । 


[        ] ঘরবাড়ি : সুমেরীয় অঞ্চলে পাথর বা কাঠের জোগান কম থাকায় অধিকাংশ ঘরবাড়ি ইট দিয়ে নির্মাণ করা হত । এক্ষেত্রে পােড়া ইট বা রােদে শুকানাে ইট ব্যবহৃত হত । বন্যার হাত থেকে রক্ষা পেতে পােড়া ইটের বাড়ি নির্মাণ করা হত । বড়াে অট্টালিকাগুলিতে গম্বুজ ও খিলানের ব্যবহার করা হত । সুমেরবাসী একতল এবং দ্বিতল —উভয় ধরনের গৃহ তৈরি করত । 


[          ] রাস্তাঘাট : সুমেরীয় সভ্যতার বাড়িগুলাের ধারেই ছিল ইট দিয়ে বাঁধানাে সরু সরু রাস্তা । রাস্তা ও বাড়িগুলাের মধ্যে ব্যবধান ছিল খুবই কম । রাস্তাঘাটগুলি যথেষ্ট পরিষ্কার - পরিচ্ছন্ন ছিল । তবে সমসাময়িক হরপ্পা সভ্যতার মতাে সুমেরীয় সভ্যতায় রাস্তার ধারে সুপরিকল্পিত পয়ঃপ্রণালী ছিল না । 

[        ] শাসন কাঠামাে : সুমেরীয় সভ্যতায় যুদ্ধবাদী রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল । রাজার নেতৃত্বে অভিজাতদের নিয়ে গঠিত কাউন্সিল পুরােহিত প্রশাসন পরিচালনা করত । এই কাজে তারা বিভিন্ন আমলা , সেনাপতি , প্রহরী, জল্লাদ প্রভৃতির সহায়তা নিত । ফলে এখানকার নাগরিকরা যথেষ্ট সুশাসন ও স্বাধীনতা পেত । 



[         ]  সুমেরীয় সভ্যতায় বসবাসকারী মানুষরা এক উন্নত জীবনযাত্রা গড়ে তােলে । তাম্র -ব্রোঞ্জ যুগের এই সভ্যতায় সমাজ ,সংস্কৃতি ও অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে তারা অগ্রগতি ঘটিয়েছিল । 



[         ] সামাজিক জীবন : সুমেরীয় সভ্যতায় মন্দিরকে কেন্দ্র করে একটি সুসংবদ্ধ সমাজ গড়ে উঠেছিল । পুরােহিত , কারিগর , বণিক , মালি ও অন্যান্য পেশার বিভিন্ন মানুষ এই মন্দির সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হত । সুমেরীয় সমাজে লুগাস নামে ভূস্বামীদের উত্থান ঘটেছিল । 


[        ] অর্থনৈতিক জীবন : সুমেরীয় সভ্যতার মানুষ কৃষি, পশুপালন , বাণিজ্য প্রভৃতি বিষয়ে পারদর্শী ছিল । 
i) কৃষি : কৃষি ছিল সুমেরের অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা । তারা নদীতে বাঁধ দিয়ে সেখান থেকে খাল কেটে কৃষিজমিতে জলসেচের ব্যবস্থা করত । টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী উর্বর অঞলে তারা গম , যব , বিভিন্ন সবজি প্রভৃতি ফসল ফলাত । সুমেরীয়দের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিল তাদের ‘জীবনবৃক্ষ’ , খেজুর গাছ । 


ii) পশুপালন : সুমেরের বাসিন্দারা গােরু, ছাগল , ভেড়া , প্রভৃতি পশু পালন করত । টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ তৃণভূমি অঞ্চলে এই সকল গৃহপালিত পশু চড়ে বেড়াত ।

iii) বাণিজ্য : ব্যাবসাবাণিজ্য ছিল সুমেরের অধিবাসীদের গুরুত্বপূর্ন পেশা । স্থলপথে পশুতে টানা গাড়ি ও জলপথে পাল তোলা নৌকার সাহায্যে সুমেরের দেশীয় ও বৈদেশিক বাণিজ্য চলত বাণিজ্যে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে প্রথমদিকে খাদ্যশস্য ও পরবর্তীকালে রৌপ মুদ্রা ব্যবহৃত হত ।



iv) অন্যান্য জীবিকা : এ ছাড়াও সুমেরের অধিবাসীরা সৈনিক , পুরােহিত , রাজকর্মচারী প্রভৃতি পেশাও গ্রহণ করত । বহু মানুষ মাছ ধরার কাজেও যুক্ত ছিল । 


[       ] সাংস্কৃতিক জীবন : সুমেরীয় সভ্যতার অধিবাসীরা শিক্ষা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতি ঘটিয়েছিল । 


1) শিক্ষা : এই সভ্যতায় বিদ্যাচর্চার যথেষ্ট প্রচলন ছিল । পণ্ডিতদের মতে , সুমেরীয়রাই সর্বপ্রথম লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করে । নিপুর শহরে এই সভ্যতার একটি গ্রন্থাগার আবিষ্কৃত হয়েছে । এখানে কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা অন্তত পাশ হাজার পােড়ামাটির ফলক মিলেছে । 

2) সাহিত্য : এই সভ্যতার মানুষেরা ধর্মসাহিত্য, রাজকাহিনি ও মহাকাব্য রচনা করেছিল । এই প্রসঙ্গে উরুকের সুমেরীয়রা রাজা গিলগামেশের বীরত্ব ,আন্তরিকতা ও ব্যর্থতার কাহিনিকে অবলম্বন করে ‘গিলগামেশ’ মহাকাব্যটি বিশেষ উল্লেখযােগ্য ।


3) শিল্পকলা : সুমেরীয়দের জীবনযাত্রায় শিল্পকলার বিশেষ গুরুত্ব ছিল । তারা কারুশিল্প ও চারুশিল্প — উভয় ক্ষেত্রেই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল । নগর -মন্দির ‘জিগুরাত’ - এর মতাে স্থাপত্য কর্ম, বাড়ি ও মন্দিরের জীবজন্তু, গাছপালা -সহ বিভিন্ন প্রকার চিত্রকলা , মৃৎশিল্প , ধাতু শিল্প, বস্ত্রশিল্প ইত্যাদি সুমেরীয়বাসীর উন্নত শিল্পকলার নিদর্শন । 

4) বিজ্ঞান : সুমেরীয়রা বিজ্ঞান -ভাবনায়ও এগিয়েছিল । পরিবহণের কাজে রথের প্রচলন , হিসাব -নিকাশের কাজে যােগ ,বিয়ােগ , গুন, ভাগ , বর্গমূল, ঘনমূল -সহ নানান গাণিতিক প্রয়োগ জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা , চিকিৎসার কাজে প্রয়ােজনীয় ঔষধের ব্যবহার তাদের উন্নত বিজ্ঞানচর্চার পরিচয় দেয় । 

 
[         ] ধর্মীয় জীবন : সুমেরীয়দের জীবনযাত্রায় ধর্মের বিশেষ গুরুত্ব ছিল । সেখানে বহু দেবদেবীর আরাধনা প্রচলিত ছিল । সুমেরের প্রতিটি নগরেই পৃথক পৃথক নগরদেবতা ছিলেন । সুমেরীয়বাসী সুউচ্চ স্থানের ওপর বিভিন্ন দেবদেবীর মন্দির নির্মাণ করত যা ‘জিগুরাত’ অর্থাৎ স্বর্গের পাহাড় নামে পরিচিত ছিল । 


উপসংহার : প্রাচীনকালে এক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে সুমেরীয়রা টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে এই উন্নত নগর সভ্যতা গড়ে তােলে । এই সভ্যতাতে নগরজীবনের ছাপ স্পষ্ট । সুমেরের নগরের পরিকল্পনা ও নাগরিক জীবনযাত্রায় যে মান লক্ষ করা যায় , তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে ।







বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন, ২০২২

সিন্ধু সভ্যতাকে হরপ্পা সভ্যতা কেন বলা হয় ? এই সভ্যতার মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের বর্ণনা দাও ।

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer সিন্ধু সভ্যতাকে হরপ্পা সভ্যতা কেন বলা হয় এই সভ্যতার মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের বর্ণনা দাও sindhu sobhotake horoppa sobhota keno bola hoi ai sobhotar manusher samajik o arthonoitik jiboner bornona dao


উত্তর : সিন্ধু সভ্যতাকে ‘ হরপ্পা সভ্যতা ’ নামেও অভিহিত করা হয় । কারণগুলি হল— 

[        ] প্রথম আবিষ্কার : সিন্ধু সভ্যতায় দীর্ঘকাল ধরে খননকার্য চালিয়ে এই সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে । হরপ্পায় সর্বপ্রথম খননকার্য চালিয়ে ( ১৯২১ খ্রি.)এই সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করা হয় বলে হরপ্পায় বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে । 

[        ] সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র : বালুচিস্তান থেকে গুজরাটের সুবিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে সিন্ধু সভ্যতার ব্যাপ্তি । হরপ্পা, মহেনজোদারাে , রােপার , লােথাল , কালিবঙ্গান , সুতকাজেনদোর , কোটডিজি , আলমগিরপুর সহ অসংখ্য কেন্দ্রে এই সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে । কিন্তু এসব কেন্দ্রগুলির মধ্যে হরপ্পাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র । 


[        ] সর্বাধিক বিস্তৃতি : হরপ্পা নগরীতে যে ধরনের সংস্কৃতি, কালানুক্রমিক ভৌগােলিক অগ্রগতি প্রভৃতির চিহ্ন প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছে সেই ধরনের চিহ্নই পরবর্তীকালে এই সভ্যতার অন্যান্য কেন্দ্রগুলিতেও পাওয়া গেছে । 


[       ] সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্রে খননকার্য চালিয়ে যেসকল নিদর্শন পাওয়া গেছে সেগুলি থেকে এই সভ্যতার মানুষের সামাজিক জীবনযাত্রা সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায় । যেমন –

[        ] সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস : অনেকে মনে করেন যে , সিন্ধু সভ্যতার সমাজ ছিল শ্রেণিবিভক্ত । ঐতিহাসিক কোশাম্বী মনে করেন যে— 

[ i ] প্রভাবশালী পুরােহিত ও শাসকগােষ্ঠী ।

[ii] বেতনভুক যােদ্ধ সম্প্রদায় । 

[iii] বণিক ,কারিগর ও ভূস্বামীদের দল এবং 

[iv] চাষি ,দরিদ্র শ্রমিক , ভৃত্য ও দাস — এই চার শ্রেণির মানুষ নিয়ে এই সভ্যতার সমাজ গড়ে উঠেছিল । 


[       ] মাতৃতান্ত্রিক সমাজ : সিন্ধু উপত্যকায় প্রাপ্ত বিভিন্ন নারীমূর্তি দেখে অনুমান করা হয় যে , এখানকার সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক । অবশ্য  এবিষয়ে বিতর্ক আছে । 


[       ] খাদ্যাভ্যাস : সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা গম ও যবের তৈরি খাবার খেত । ভাতের প্রচলনও ছিল । এ ছাড়া পশুর মাংস , খেজুর , দুধ, মাছ প্রভৃতি খাদ্য তারা গ্রহণ করত । 


[        ] পােশাক : এখানকার অধিবাসীরা সুতি ও পশমের পােশাক পড়ত । তারা সাধারণত দুটি বস্ত্রখণ্ড পােশাক দেহের হিসেবে ব্যবহার করত । একটি খণ্ড দেহের উধ্বাংশের এবং অপর খণ্ডটি দেহের নিম্নাংশের জন্য ব্যবহার করত । 

[        ] অলংকার : সিন্ধুবাসীরা নারী -পুরুষ উভয়েই ধাতুর তৈরি অলংকার পড়ত । কানের দুল , চুরি, আংটি , মল , কোমরবন্ধ , মালা প্রভৃতি তারা অলংকার হিসেবে ব্যবহার করত । নারীরা বিভিন্নভাবে চুল বাঁধত । 


[       ] বিনােদন : পাশাজাতীয় খেলা , শিকার প্রভৃতি ছিল সিন্ধু বাসীদের অবসর বিনােদনের প্রধান মাধ্যম । এ ছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে নাচ , গান , ষাঁড় ও পাখির লড়াইয়ের আয়ােজন করা হত । 


[       ] সিন্ধু সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলি থেকে এখানকার মানুষের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার আভাসও পাওয়া যায় । 


i) পশুপালন : সিন্ধু সভ্যতার অর্থনীতিতে পশুপালনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল । গােরু , মহিষ , ভেড়া , ছাগল , শূকর উট , প্রভৃতি পশুকে তারা পােষ মানাতে শিখেছিল । সিন্ধুর অধিবাসীরা গৃহপালিত পশুকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করত । এ ছাড়া গােরু ও মহিষকে চাষে লাঙল টানার কাজে ব্যবহার করত ।


ii) কৃষি : এই সভ্যতার বাসিন্দাদের প্রধান কৃষিজাত ফসল ছিল গম , যব , তিল ,মটর ,রাই ,বাদাম প্রভৃতি । সিন্ধু নদীর জল তারা জমিতে সেচের কাজে লাগাত । এ ছাড়া বিভিন্ন নদীতে বাঁধ দিয়ে জলাশয় তৈরি করা হত । নিড়ানি , লাঙল , কাস্তে প্রভৃতি যন্ত্রপাতি তারা কৃষিকাজে ব্যবহার করত । 


iii) শিল্প : সিন্ধু সভ্যতায় ধাতুশিল্প ,মৃৎশিল্প, অলংকার শিল্প ,বস্ত্রবয়ন শিল্প প্রভৃতির প্রচলন ছিল । তামা ও ব্রোঞ্জের সাহায্যে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, সােনা ও রুপাে দিয়ে অলংকার প্রভৃতি তৈরি হত । মৃৎপাত্র ও খেলনাগুলিতে বিভিন্ন নকশা করা হত । 


iv) বাণিজ্য : সিন্ধু সভ্যতার বাসিন্দারা অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল ।নিকটবর্তী বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে পশুটানা গাড়ি বা জলযানের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ স্থানীয় বাণিজ্যের পণ্যসামগ্রির লেনদেন চলত । বেলুচিস্তান ,আফগানিস্তান,ইরান ,মিশর,মেসােপটেমিয়া, প্রভৃতি দেশের সঙ্গে এই সভ্যতার বৈদেশিক বাণিজ্য চলত ।

 





বুধবার, ২৯ জুন, ২০২২

মেহেরগড় সভ্যতার বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে আলােচনা করাে ।

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer মেহেরগড় সভ্যতার বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে আলােচনা করাে mehergor sobhotar boishistoguli somporke alochona koro


উত্তর : উল্লিখিত খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত ৭ টি পর্যায় থেকে এই সভ্যতার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলি পাওয়া যায় । যেমন— 

[        ] প্রাচীনত্ব : মেহেরগড় সভ্যতার সূচনাকাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ অব্দ । কার্বন -১৪ পরীক্ষায় জানা গেছে যে , এই সভ্যতা আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল । সভ্যতাটি ৭ টি পর্যায়ে বিকশিত হয় এবং চতুর্থ থেকে সপ্তম পর্যায়ে এই চূড়ান্ত বিকাশ লাভ করে ।


[        ] প্রাগৈতিহাসিক যুগের সভ্যতা : মেহেরগড় সভ্যতায় খননকার্য চালিয়ে বিভিন্ন হাতিয়ার , ইট , পাথর , মৃৎপাত্র সিলমােহর প্রভৃতি পাওয়া গেছে । কিন্তু এই সভ্যতায় কোনাে লিপি বা লিখিত উপাদান পাওয়া যায়নি । তাই মেহেরগড় সভ্যতাকে ‘প্রাগৈতিহাসিক যুগের সভ্যতা’ বলে চিহ্নিত করা হয় । 

[         ] তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতা : মেহেরগড় সভ্যতা নব্যপ্রস্তর যুগের সভ্যতা হলেও পাথরের হাতিয়ারের পাশাপাশি এই সভ্যতার প্রথম পর্যায়ে একটি তামার পূতি এবং তৃতীয় পর্যায়ে তামার সিলমােহর, পােড়ামাটির পাত্রে তামার অংশ পাওয়া গেছে । তাই এই  সভ্যতার তৃতীয় পর্যায় তাম্র -প্রস্তর যুগের অন্তর্গত বলে মনে করা যায় । 


[         ] বিস্তার : মেহেরগড় সভ্যতার প্রধান কেন্দ্র ছিল মেহেরগড় । মেহেরগড় ছাড়াও কুল্লি, রানা ঘূনডাই , পেরিয়ানাে ঘূনডাই , কিলেগুল মহম্মদ , নুরা , তরকাইকেল্লা , গাজিশাহ , কোটদিজি প্রভৃতি কেন্দ্রে এই সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে । বালুচিস্তানের ঝােব নদীর দক্ষিণ উপত্যকা থেকে সিন্ধুন দের সমগ্র পশ্চিম অংশ পর্যন্ত এই সভ্যতা বিস্তৃত ছিল ।

[         ] নদীমাতৃক সভ্যতা : পৃথিবীর অন্যান্য নদীমাতৃক সভ্যতাগুলির মতােই মেহেরগড় সভ্যতাও নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল । এই সভ্যতার উত্তরে ছিল ঝোব নদী এবং পূর্ব দিকে ছিল সিন্ধু নদ ।তাই মেহেরগড় সভ্যতাকে ‘নদীমাতৃক সভ্যতা’ বলা হয় । 



[         ] সামাজিক বৈষম্য : মেহেরগড় সমাজ ছিল বৈষম্যমূলক ।

 i) সমাধিতে পার্থক্য : এখানকার কোনাে কোনাে সমাধিতে মৃতদেহের সঙ্গে প্রচুর মূল্যবান সামগ্রির উপস্থিতি এবং কোনাে কোনাে সমাধিতে সেগুলির অনুপস্থিতি মেহেরগড়ের সামাজিক বৈষম্যকে তুলে ধরে । 
 
ii) অন্যান্য পার্থক্য : আবার শস্য মজুত রাখার পদ্ধতি , ব্যবহৃত হস্তশিল্পের সামগ্রী প্রভৃতির পার্থক্যও সমাজে শ্রেণিবৈষম্য ও শ্রেণিবিভাজনের ইঙ্গিত দেয় । 

[         ] হাতিয়ার নির্মাণ : মেহেরগড়বাসী মূলত পাথরের হাতিয়ার নির্মাণ করত । এখানকার হাতিয়ারগুলির মধ্যে ছিল বিটুমিনজাতীয় পাথর খণ্ডে নির্মিত কাস্তে, নিড়ানি , জাঁতা , হামানদিস্তা প্রভৃতি। এই সভ্যতার অধিকাংশ মানুষ কৃষিকর্মে নিযুক্ত থাকায় কৃষিকাজের উপযুক্ত হাতিয়ারই বেশি সংখ্যায় পাওয়া গিয়েছে ।


[         ] পশুপালন : প্রথমদিকে মেহেরগড়বাসী শিকারের কাজে নিযুক্ত থাকলেও পরবর্তীকালে পশুপালনে মন দেয় । ছাগল , কুঁজওলা ষাঁড়, ভেড়া , মােষ প্রভৃতি পশুকে তারা পােষ মানিয়েছিল । 

[        ] কৃষিকাজ : পরবর্তীকালে মেহেরগড় বাসিন্দারা যাযাবর জীবন ছেড়ে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তােলে এবং কৃষিকাজ শুরু করে । যব ,গম , কার্পাস, প্রভৃতি ছিল তাদের প্রধান কৃষিজ ফসল ।তারা কৃষির প্রয়ােজনে বাঁধ নির্মাণ করে জলসেচের ব্যবস্থা রপ্ত করেছিল ।

[        ] কারিগরি উৎপাদন : মেহেরগড় সভ্যতায় মৃৎশিল্প, ধাতু শিল্প, অলঙ্কার শিল্প ,বস্ত্রবয়নশিল্প প্রভৃতির বিকাশ ঘটেছিল । মাটির জিনিসপত্র তৈরির পাশাপাশি তারা গলানাে ধাতু, শঙ্খ, নীলকান্তমণি ,চুনি ,লাপিস লাজুলি প্রভৃতি পাথর দিয়ে অলঙ্কার নির্মাণ করত । কার্পাসের তুলো দিয়ে সুতাে তৈরি করে কাপড় বােনার কাজও তারা রপ্ত করেছিল । 

[         ] বৈদেশিক সম্পর্ক : মেহেরগড় সভ্যতায় মৃৎপাত্রের ধরন ,নির্মাণ প্রণালী, নীলকান্তমণির ব্যবহার প্রভৃতি দেখে পণ্ডিতরা অনুমান করেন যে মধ্য এশিয়া , আফগানিস্তান , পারস্য প্রভৃতির সঙ্গে মেহেরগড় সভ্যতার যােগাযােগ ছিল । অধ্যাপক ড . রণবীর চক্রবর্তী মনে করেন যে শঙ্খ ও লাপিস লাজুলি বাইরে থেকে এখানে এসেছে । তার মতে , মেহেরগড়ে প্রাপ্ত তামার সিলমােহরগুলি তাদের ব্যাবসাবাণিজ্যের কাজে যুক্ত থাকার প্রমাণ দেয় । 


উপসংহার : মেহেরগড় সভ্যতার বৈশিষ্ট্যগুলি থেকে বেশিরভাগ গ্রামীণ চিত্র উঠে এলেও এই সভ্যতার চূড়ান্ত বিকাশকাল অর্থাৎ চতুর্থ থেকে সপ্তম পর্যায়ে সভ্যতাটি ক্রমে নগরজীবনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে । অধ্যাপক ড . ব্রতীন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায় মনে করেন যে , মেহেরগড়ের নগরায়ণ পরবর্তী সিন্দু সভ্যতায় পরিণত রূপ লাভ করেছিল ।






মঙ্গলবার, ২৮ জুন, ২০২২

হরপ্পা সভ্যতার বৈশিষ্ট্যগুলি লেখাে ।

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer হরপ্পা সভ্যতার বৈশিষ্ট্যগুলি লেখাে horoppa sobhotar boishistoguli lekho


উত্তর :  সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় । যেমন— 

[      ] প্রাচীনত্ব : হরপ্পা সভ্যতা কতটা প্রাচীন, অর্থাৎ কবে এই সভ্যতার সূচনা ও অবলুপ্তি ঘটেছিল তা নিয়ে পণ্ডিতরা একমত নন ।

 i) সূচনাকাল : স্যার জন মার্শালের মতে , হরপ্পা সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল ৩,২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২,৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে । ঐতিহাসিক ড .সি . জে .গ্যাড ও ড .ফ্যারি খ্রিস্টপূর্ব ২,৩৫০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১,৭৭০ অব্দকে এই সভ্যতার বিকাশকাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন । হুইলার হরপ্পা সভ্যতার সূচনাকাল হিসেবে খ্রিস্টপূর্ব ২,৫০০ অব্দকে চিহ্নিত করেছেন ।

ii) অবলুপ্তির কাল : মাটিমার হুইলার মনে করেন যে , বহিরাগত আর্য জাতির আক্রমণ হরপ্পা সভ্যতার পতনের একটি প্রধান কারণ ছিল । তাই ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আর্যদের ভারতে আগমনের কালকেই তিনি হরপ্পা সভ্যতার অবলুপ্তির কাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন । অধিকাংশ পণ্ডিত এই অভিমত মেনে   নিয়েছেন । 

[        ] প্ৰায় - ঐতিহাসিক যুগের সভ্যতা : হরপ্পা সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রীর মধ্যে লিপির অস্তিত্ব মিলেছে যা ‘সিন্ধুলিপি’ নামে পরিচিত । কিন্তু এই লিপির পাঠোদ্ধার আজও সম্ভব হয়নি । তাই হরপ্পা সভ্যতা হল ‘প্রায় - ঐতিহাসিক যুগের সভ্যতা’ । লিপির পাঠোদ্ধার না হওয়ায় এই সভ্যতার ইতিহাস রচনার কাজে খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রীর ওপর নির্ভর করতে হয় । 


[        ] তাম্র -প্রস্তর যুগের সভ্যতা : হরপ্পা সভ্যতার মানুষ লােহার ব্যবহার জানত না । এখানকার বাসিন্দারা পাথর এবং তামা দিয়ে হাতিয়ার তৈরি করত । এজন্য হরপ্পা সভ্যতাকে ‘তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতা’ বলা হয় । পরবর্তীকালে এখানে তামার সঙ্গে টিন মিশিয়ে তৈরি ব্রোঞ্জের ব্যবহারও শুরু হয় । 


[         ] বিস্তার : পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে হরপ্পা সভ্যতা ছিল সর্ববৃহৎ । এই সভ্যতা সিন্ধু নদের অববাহিকা অঞ্চল ছাড়াও বহুদুর বিস্তৃত ছিল । উত্তরে জম্মুর নিকটবর্তী মান্ডা থেকে দক্ষিণে দাইমাবাদ এবং পূর্বে দিল্লির নিকটবর্তী আলমগিরপুর থেকে পশ্চিমে ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত এই সভ্যতার আয়তন ছিল প্রায় সাড়ে বারাে লক্ষ বর্গকিলােমিটার । ছােটো বড়াে মিলিয়ে অন্তত ১৫০০ টি কেন্দ্রে এই সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে । 

[        ] নদী মাতৃক সভ্যতা : পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতাগুলির মতাে হরপ্পা সভ্যতাও নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে । সিন্ধু-সহ পার্শ্ববর্তী রাভি বা ইরাবতী , ঘর্ঘরা, শতদ্রু, ভােগাবর প্রভৃতি নদী এবং বেশকিছু শাখানদী ও উপনদীর বিস্তীর্ণ অববাহিকা অঞ্চলে এই সভ্যতার প্রসার ঘটে । এজন্য হরপ্পা সভ্যতাকে ‘ নদীমাতৃক সভ্যতা ’ বলা হয় । 


[         ] নগর পরিকল্পনা : হরপ্পা সভ্যতা ছিল সুপ্রাচীন নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা । এখানে সুবিন্যস্ত রাস্তাঘাট, রাস্তার পাশে ম্যানহােলযুক্ত ভূগর্ভস্থ পয়ঃপ্রণালী, পরিকল্পিত ঘরবাড়ি , স্নানাগার , শস্যাগার প্রভৃতি বিভিন্ন নাগরিক পরিষেবার অস্তিত্ব ছিল । নগরের সুরক্ষা, পরিচ্ছন্নতা, নাগরিকদের রুচিবােধ , কর্মপ্রচেষ্টা,স্বাস্থ্যসচেতনতা ও দক্ষতা এই সবগুলি এক উন্নত নগর সভ্যতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে । 



[        ] পৌরব্যবস্থা : রাস্তাঘাট , ঘরবাড়ি , ওজন ও মাপব্যবস্থা প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে এই সভ্যতার বিভিন্ন নগরগুলিতে সাদৃশ্য লক্ষ করে বিভিন্ন পণ্ডিত অনুমান করেছেন যে , এই সভ্যতায় একটি সুপরিকল্পিত কেন্দ্রীভূত পৌরব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল । ঐতিহাসিক এস , কে , সরস্বতী বলেছেন যে ,“এই সাদৃশ্য থেকে বােঝা যায় যে , এখানে একটি শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত কর্তৃপক্ষের অস্তিত্ব ছিল যারা বিস্তৃত এই অঞ্চলের মানুষের জীবন ও রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করত ।”
[         ] আধুনিকতা : হরপ্পা সভ্যতা অন্তত পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন হলেও এই সভ্যতায় বহু আধুনিক বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব ছিল । যেমন –

i) রাস্তায় গ্যাসের আলাে ।

ii)  আধুনিক যুগের মতাে মেয়েদের লিপস্টিক , নেলপলিশ , ভ্যানিটি ব্যাগের ব্যবহার । 

iii) নাগরিকদের স্বাস্থ্য সচেতনতা প্রভৃতি বিষয়গুলি এযুগের মানুষের আধুনিকতার পরিচয় দেয় ।



[      ] উপসংহার : হরপ্পা সভ্যতা প্রাচীন ভারত তথা বিশ্ব ইতিহাসের এক বিস্ময়কর অধ্যায় । এখানকার উন্নত রাস্তাঘাট , ঘরবাড়ি , পয়ঃপ্রণালী , স্নানাগার , শস্যাগার , উন্নত পৌরব্যবস্থা , বিভিন্ন আধুনিক সামগ্রির ব্যবহার , স্বাস্থ্য-সচেতনতা প্রভৃতি এই সভ্যতাকে শুধু ভারতে নয় , সমগ্র বিশ্ব ইতিহাসে বিশিষ্টতা দান করেছে । 





রবিবার, ২৬ জুন, ২০২২

নব্য প্রস্তর বা নতুন পাথরের যুগের মানবজীবনের নানা দিকগুলি উল্লেখ করাে ।

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer নব্য প্রস্তর বা নতুন পাথরের যুগের মানবজীবনের নানা দিকগুলি উল্লেখ করাে nobbo prostar ba notun pathorer juger manobjiboner nana dikguli ullekh koro


উত্তর : নব্য প্রস্তর যুগের মানবজীবনের বিভিন্ন দিক জীবিকা 
i) পশুপালন : এযুগের মানুষ পশুপালনের কৌশল আয়ত্ত করে । কুকুর , ভেড়া , গােরু, গাধা , হাতি প্রভৃতি পশুকে তারা পােষ মানাতে শেখে । খাদ্যের জোগান ছাড়াও গৃহপালিত পশুকে তারা যাতায়াতের কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে । 


ii) কৃষির সূচনা : নব্য প্রস্তর পর্বে আবাসস্থলের পাশে বীজ বা গাছের শিকড় পুঁতে দেওয়া শুরু হয় । এভাবেই কৃষির সূচনা ঘটে । 

[       ] সমাজ : এযুগে পরিবারগুলির সামাজিক কাঠামাে আরও সুসংঘবদ্ধ হয় । সমাজে একক বা দলগত বিবাহরীতি চালু হয় । সমাজে বিনিময়প্রথার উদ্ভব ঘটে এবং শ্রমবণ্টন ব্যবস্থাচালু হয় । 

[       ] আশ্রয়স্থল : নব্য প্রস্তর যুগের শেষের দিকে মানুষ স্থায়ী আবাস নির্মাণ করতে শেখে । গাছের ডালপালা ও ঘাসপাতা দিয়ে তারা কুটির বানাতে শেখে । সুইটজারল্যান্ডের আদিম অধিবাসীরা হ্রদের মধ্যে খুঁটি পুঁতে তার ওপর মাচা বেঁধে বসবাস করত এমন নিদর্শন মিলেছে । 


[        ] হাতিয়ার : নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ আগের তুলনায় অনেক উন্নত মানের হাতিয়ার ব্যবহার করতে শুরু করে । এই পর্বের উল্লেখযােগ্য পাথরের হাতিয়ারগুলি ছিল কাটারি , নিড়ানি, ছেনি, বাটালি , কাস্তে , বর্শার ফলা ,ছােরা ,উঁচ প্রভৃতি । কুঠার , কোদাল -সহ বেশ কিছু হাতিয়ারে কাঠের হাতল লাগানাের কৌশল এসময় চালু হয় । 
[        ] আগুনের ব্যবহার : নব্য প্রস্তরযুগে মানুষ পাথর ভাঙার মধ্য দিয়ে প্রথম আগুন জ্বালানাের কৌশল আবিষ্কার করে । আগুনের সাহায্যে তারা কাঁচা মাংস আগুনে পুড়িয়ে নিয়ে বা সেদ্ধ করে খেতে শিখল ,গুহার মুখে আগুন জ্বালিয়ে বুনাে জানােয়ারদের তাড়াতে শিখল এবং শীতের হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে শিখল ।

[        ]  চাকার আবিষ্কার : নব্য প্রস্তর যুগে এক তাৎপর্যপূর্ণ আবিষ্কার হল ‘চাকা’ । চাকার ব্যবহারের মাধ্যমে মৃৎপাত্র উৎপাদনে পরিবর্তন আসে , পাশাপাশি চাকাকে কাজে লাগিয়ে যানবাহন  তৈরির ধারণা সৃষ্টি হয় । 

[       ] ভাষার উন্নয়ন : নব্য প্রস্তর যুগে ভাষার উন্নতি ঘটেছিল । এযুগে সমাজ কাঠামাে অনেক সংঘবদ্ধ হওয়ায় নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেশ কিছু ভাষার আত্মপ্রকাশ ঘটে । 
i) বস্ত্রবয়নশিল্প  : নব্য প্রস্তর যুগে বস্ত্রবয়ন শিল্পের সূচনা ঘটেছিল । শণের আঁশ থেকে তৈরি সুতাে দিয়ে এসময়ের কারিগররা লিনেন কাপড় বুনতে শেখে । মেসােপটেমিয়ার কারিগররা ভেড়ার লােম দিয়ে পশমি কাপড় বানাতে শেখে । 

ii) মৃৎশিল্প : নব্য প্রস্তর যুগে মৃৎশিল্পে অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটে । চাকাকে কাজে লাগিয়ে কম সময়ে অনেক বেশি সংখ্যক মাটির পাত্র তৈরি হতে থাকে । মাটির তৈরি পাত্রকে পুড়িয়ে শক্ত করার কৌশল আবিষ্কৃত হয় । পাত্রগুলির গায়ে নানা ধরনের নকশা এবং রং করার কৌশল চালু হয় । 


[       ] শিল্পকলা ও ধর্মবিশ্বাস : নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ পাথর কেটে দেবীমূর্তি গড়তে শিখেছিল । মেসােপটেমিয়ার ইউবেইদ এবং ইজিয়ান সভ্যতার ক্রীটে এই ধরনের মূর্তি মিলেছে । 


উপসংহার : প্রত্নতাত্ত্বিক যুগের মধ্যে একটি উল্লেখযােগ্য পর্যায় ছিল নব্য প্রস্তর যুগ । এই সময় মানুষ কৃষিকাজ , স্থায়ী বসতি নির্মাণ, আগুনের ব্যবহার প্রভৃতি শেখে এবং তারা খাদ্য সংগ্রহকারী থেকে খাদ্য উৎপাদনকারীতে পরিণত হয় । সর্বোপরি , এই পরিবর্তনগুলি ছিল পূর্বের তুলনায় অনেক দ্রুত। তাই কৃষিসহ বিভিন্ন বিষয়ের এইসব ব্যাপক অগ্রগতিকে ঐতিহাসিক ভি .গর্ডন চাইল্ড ‘নব্য প্রস্তর যুগের বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেছেন ।





শনিবার, ২৫ জুন, ২০২২

কীভাবে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আদিম মানুষ শিকারি খাদ সংগ্রাহক থেকে বসবাসকারীতে পরিণত হয় ।

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer কীভাবে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আদিম মানুষ শিকারি খাদ সংগ্রাহক থেকে বসবাসকারীতে পরিণত হয় kivabe bibortoner modhey diye adim manush shikari khad songrahok theke bosobaskarite porinoto hoi


উত্তর : আদিম মানুষ শিকারী খাদ্য সংগ্রাহক থেকে স্থায়ী বসবাসকারী 

i) হাতিয়ার : হােমাে স্যাপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষের আবির্ভাবের আগে অনুন্নত মানুষ পাথর ও লাঠির বেশি কোনাে হাতিয়ারের ব্যবহার জানত না । পরবর্তীকালে মানুষ পাথরের বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার তৈরি করতে শেখে । যুগের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তাদের হাতিয়ার গুলিও উন্নত হতে থাকে ।   


ii) শিকারে অংশগ্রহণ : এসময় পুরুষরা শিকারের কাজে অংশ নিত । তারা পাথর ও হাড়ের তৈরি হাতিয়ার বা অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে পশু শিকার করত এবং শিকার করা পশুর মাংস সংগ্রহ করত ।

iii) দলবদ্ধতা : এ যুগের মানুষ একাকী শিকারে না গিয়ে দলবদ্ধভাবে শিকারে বের হত । এভাবে প্রাচীন কালে শিকারি মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠা দল বা সংগঠনটিকে ‘ক্ল্যান’ নামে অভিহিত করা হয় । রক্তের সম্পর্ক আছে এমন মানুষদের নিয়ে মূলত ক্ল্যান গঠিত হত ।


iv) গােষ্ঠীর ভূমিকা : প্রতিটি মানবগােষ্ঠীই নির্দিষ্ট এলাকায় শিকার করত । সেখানে অন্য গােষ্ঠীর শিকারের অধিকার থাকত না । খুব বড়াে শিকার ধরার উদ্দেশ্যে কখনাে -কখনাে কয়েকটি ক্ল্যান ঐক্যবদ্ধ হয়ে যেত । এরূপ সমবায়ের অন্তর্ভুক্ত সমাজকে বলা হত ‘ ট্রাইব ’ । 


v) মাংস বণ্টন : শিকার করে পাওয়া পশুর মাংস তারা সকলের মধ্যে ভাগ করে নিত । প্রথমদিকে তারা আগুনের ব্যবহার জানত না বলে কাঁচা মাংস খেত । পরবর্তীকালে আগুনের ব্যবহার শিখে তারা মাংস পুড়িয়ে খাওয়ার অভ্যাস করে । 

[       ] নারীর খাদ্য সংগ্রহ : পরিবারের নারীরা নিকটবর্তী বনজঙ্গল থেকে বিভিন্ন ধরনের ফলমূল , শাকসবজি , পাখির ডিম প্রভৃতি সংগ্রহ করত । তারা পরিবারের সদস্যদের জন্য খাবার তৈরি করত এবং সন্তানের যত্নাদি করত । খাদ্য রাখার প্রয়ােজনীয় মৃৎপাত্রগুলিও মেয়েরাই তৈরি করত । এভাবে খাদ্য সংগ্রহকে কেন্দ্র করে সুদূর অতীতে পুরুষ ও নারীদের মধ্যে শ্রমবিভাজন গড়ে উঠেছিল । 


[       ] আদিম মানুষের সংস্কৃতি : প্রাগৈতিহাসিক যুগে দীর্ঘকাল ধরে শিকারি আদিম মানুষের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল । শিকারি ও খাদ্যসংগ্রাহক আদিম মানুষের সংস্কৃতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি হল— 

i) লােম ও হাড় সংগ্রহ : আদিম মানুষ পশুর মাংস বা দুধ ছাড়াও পশুর লােম ,চামড়া ও হাড় সংগ্রহ করত । চামড়া ও লোম দিয়ে তারা পরিধেয় বস্ত্র, শীতবস্ত্র এবং পশুর হাড় ও শিং দিয়ে তারা বিভিন্ন হাতিয়ার তৈরি করল । 

ii) বাসগৃহ নির্মাণ : নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ গােষ্ঠীবদ্ধভাবে নদী বা জলাশয়ের ধারে বাসগৃহ নির্মাণ করতে শুরু করে । তাদের তৈরি বাসগৃহগুলি ছিল তিন ধরনের , যথা —স্থল বসতি , হ্রদ বসতি , গুহা বসতি ।

iii) খল বসতি : মাটির ওপর কৃষিজমির ধারে তৈরি হত স্থলবসতি । বড়াে বড়াে পাথরের চাই দিয়ে তৈরি হত ঘরের দেয়ালগুলি । পাথর ছাড়া মাটি, কাঠ, পাথর ,বাঁশ, চামড়া প্রভৃতি উপকরণকে কাজে লাগিয়ে স্থলবসতিগুলি নির্মিত হত । 

iv) হ্রদ বসতি : হ্রদের জলের মধ্যে এই ধরনের ঘর তৈরি করা হত । সুইটজারল্যান্ডের নিউচ্যাটেল হ্রদে এই ধরনের বসতি নির্মিত হয়েছিল বলে জানা গেছে । 

v) গুহা বসতি : আদিমকাল থেকেই মানুষ ছিল গুহাবাসী । তাই নতুন পাথরের যুগে এসে মানুষ গুহায় বাস করার অভ্যাস একেবারে ত্যাগ করতে পারেনি । 

[       ] স্থায়ী বসতির মানােন্নয়ন : নতুন পাথরের যুগের মানুষের যাযাবর জীবন ছেড়ে স্থায়ী বসতি জীবনে প্রবেশ এই পর্বে আরও উন্নত রূপ লাভ করে । সময় এগােনাের সঙ্গে সঙ্গে বসতির সংখ্যা বেড়ে ছােটো ছোটো গ্রাম গড়ে উঠতে শুরু করে । এ যুগের শেষের দিকে রােদে শােকানাে ইট দিয়ে বাড়ি তৈরি শুরু হয় । 

উপসংহার : আদিম যাযাবর থেকে স্থায়ী বসবাসকারীতে পরিণত হতে মানুষের দীর্ঘ সময় লেগেছিল । বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষ যাযাবর জীবনকে ফেলে এসে স্থায়ী জীবনের স্বাদ পায় । এর ফলে মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটে ।



শুক্রবার, ২৪ জুন, ২০২২

প্রাচীন ভারতীয় সমাজে নারীর বিবাহরীতি সম্পর্কে আলােচনা করাে ।

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer প্রাচীন ভারতীয় সমাজে নারীর বিবাহরীতি সম্পর্কে আলােচনা করাে prachin bharotiyo somaje narir bibahoriti somporke alochona koro


উত্তর : এম . উইন্টারনিজ , আর . ফিক , রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ মনে করেন যে , প্রতিটি যুগের ধর্মব্যবস্থা নারীর তৎকালীন সামাজিক অবস্থানকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল । 
ঋগবৈদিক যুগ : ঋগবৈদিক যুগের সমাজে নারী যথেষ্ট মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিল । সাধারণভাবে এযুগে নারীর বহুবিবাহ এবং বাল্যবিবাহ প্রচলিত ছিল না । নারীরা স্বাধীনভাবে নিজেদের পতি নির্বাচন করতে পারত । বিধবা নারীদের ক্ষেত্রে দেবরকে বিবাহ করার রীতিও প্রচলিত ছিল ।বহু নারী বিবাহ না করে বিদ্যাচর্চা এবং শাস্ত্রালােচনার মধ্য জীবন কাটাতেন । 

পরবর্তী বৈদিক যুগ : পরবর্তী বৈদিক যুগের সমাজে বাল্যবিবাহ , বহুবিবাহ প্রভৃতির প্রচলন নারীর মর্যাদা হ্রাসের প্রমাণ দেয় । এযুগে নারীর বিবাহ পদ্ধতি ক্রমশ জটিল হয় এবং বিধবাবিবাহের প্রচলন ঘটে । এযুগে উচ্চ সম্প্রদায়ে বিশেষত রাজপরিবারে বহুবিবাহের রীতি ছিল । উচ্চবর্ণের সঙ্গে সঙ্গে নিম্নবর্ণের অথবা একই বর্ণ বা জাতির মধ্যে বিবাহের রীতি প্রচলিত ছিল । স্বগােত্রে বিবাহের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ ছিল । 


মৌর্য যুগ : মৌর্য যুগে চার ধরনের বৈধ বা শাস্ত্রীয় এবং চার ধরনের অশাস্ত্রীয় বিবাহরীতি প্রচলিত ছিল । মেগাস্থিনিসের লেখা থেকে জানা যায় , এসময়ে নিজ জাতি এবং নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহের প্রচলন ছিল । ‘অর্থশাস্ত্র’ থেকে জানা যায় যে , এসময় আট ধরনের বিবাহরীতি এবং বিধবা বিবাহের প্রচলন ছিল । ‘পরাশর সংহিতা’য় উল্লেখ করা হয়েছে যে ,এযুগে স্বামী সন্ন্যাস নিলে বা নিরুদ্দিষ্ট হলে নারী পুনরায় বিবাহ করতে পারত ।  

মৌর্য পরবর্তী যুগে : মৌর্য পরবর্তী যুগের সমাজে নারীর বিবাহরীতি নিয়ে ‘মনুসংহিতাস্মৃতি’ তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে , নারী প্রথম জীবনে পিতার অধীনে , বিবাহের পর স্বামীর অধীনে এবং পরবর্তী   জীবনে পুত্রের অধীনে বার্ধক্য জীবন কাটাবে । ‘মনুসংহিতাস্মৃতি’ তে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিবাহিত নারী একান্তভাবেই স্বামীর ওপর নির্ভরশীল । মৌর্যোত্তর সমাজে ‘অনুলােম’ ও ‘প্রতিলােম’ —এই দুই বিবাহরীতিরই প্রচলন ছিল । 


গুপ্তযুগ : গুপ্তযুগে যৌবনপ্রাপ্তির আগে ও পরে , এই দুই অবস্থাতেই নারীদের বিবাহ দেওয়ার রীতি ছিল । পুরুষপ্রধান সমাজে পুরুষরা একাধিক পত্নী গ্রহণ করতে পারতেন । স্মৃতিশাস্ত্রের বিধান অমান্য করেও এযুগে অনুলােম ও প্রতিলােম বিবাহরীতি চালু ছিল । কন্যাদের বিবাহের সাক্ষ্য পাওয়া যায় । সাধারণত ব্রায়,প্রাজাপত্য আর্য ও দৈব এই চার ধরনের বিবাহরীতি অধিক প্রচলিত ছিল । তবে রাজপরিবার গুলির মধ্যে গান্ধর্ব মতে বিবাহ হত বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে । 


গুপ্ত পরবর্তী যুগ : এযুগে সাধারণত ১২ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মেয়েদের বিবাহের আয়ােজন করা হত । উচ্চবিত্ত সমাজে বিধবাদের পুনরায় বিবাহের রীতি প্রচলিত ছিল । গুর্জর প্রতিহার সমাজে সাধারণত নারীদের বিবাহ হত স্ববর্ণে , কিন্তু ভিন্ন গােত্রে । পাল সেন যুগে বহুবিবাহ , বাল্যবিবাহ , স্ববর্ণ ও অস্বর্ণ বিবাহরীতি ( অনুলােম ও প্রতিলােম ) প্রচলিত ছিল । বিবাহে যৌতুক দানের প্রথা ছিল । কৌলিন্য প্রথার সুযােগ নিয়ে কুলীন ব্রাত্মণরা একাধিক বিবাহ করত । 

উপসংহার : পরবর্তী সময়ে বিশেষত সুলতানি আমলে হিন্দু মুসলমান সমাজে মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দেওয়া হত । তুর্কি অভিজাতদের নানান গােষ্ঠীর মুসলমানরা হিন্দু নারীদের বিবাহ করেছিলেন ।



বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন, ২০২২

প্রাচীন মিশরে ক্লিওপেট্রার পরিচয় ও কার্যাবলি সম্পর্কে আলােচনা করাে ।

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer প্রাচীন মিশরে ক্লিওপেট্রার পরিচয় ও কার্যাবলি সম্পর্কে আলােচনা করাে prachin mishore kliopetrar porichoy o karjaboli somporke alochona koro

উত্তর : মিশরের ইতিহাসে যে ক্লিওপেট্রার নাম সর্বাধিক প্রসিদ্ধ, তিনি হলেন মিশরের টলেমি বংশের শেষ শাসক সপ্তম ক্লিওপেট্রা । ক্লিওপেট্রা ৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসে জন্মগ্রহণ করেন । দ্বাদশ টলেমির কন্যা ক্লিওপেট্রা ছিলেন অসাধারণ বুদ্ধিমতী এবং উচ্চশিক্ষিতা নারী ।
সিংহাসনলাভ : সুন্দরী অষ্টাদশী ক্লিওপেট্রা প্রথমদিকে তাঁর পিতার সহশাসক হিসেবে মিশর শাসন করলেও পিতার মৃত্যুর পর তার চেয়ে বয়সে আট বছরের ছােটো ভাই ত্রয়ােদশ টলেমিকে বিবাহ করে মিশরে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন । এর কারণ হল , মিশরের প্রচলিত রীতি ছিল কোনাে সঙ্গীর সঙ্গে যৌথভাবে দেশশাসন করতে হবে । 


জুলিয়াস সিজারের বন্ধুত্ব লাভ : রােমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার ৪৭ খ্রিস্টাব্দে মিশর অভিযান করলে ক্লিওপেট্রা পরাজিত হন এবং ক্লিওপেট্রাকে রােমে আনা হয় । কিছুদিনের মধ্যেই ক্লিওপেট্রা ও রােমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে । জুলিয়াস সিজার ক্লিওপেট্রাকে পুনরায় মিশরের শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করেন । 


মিশরে প্রত্যাবর্তন : সিজার ব্রুটাস নামে এক আততায়ীর হাতে নিহত ( ৪৪ খ্রিস্টপূর্ব) হলে ক্লিওপেট্রা মিশরে ফিরে আসেন এবং তার অপর ছােটো ভাই চতুর্দশ টলেমিকে নামমাত্র বিবাহ করে মিশর শাসন করতে থাকেন । এক বছরের মধ্যেই চতুর্দশ টলেমিকে হত্যা করে ক্লিওপেট্রা জুলিয়াস সিজারের ঔরসজাত সন্তান পঞ্চদশ টলেমির ( সিজারিয়ন ) সঙ্গে মিলিতভাবে মিশর শাসন করতে থাকেন ।

অ্যান্টনির সাথে বিবাহ : জুলিয়াস সিজার নিহত হওয়ার তিন বছর পর রােমান সেনাপতি ও জুলিয়াস সিজারের বন্ধু মার্ক অ্যান্টনি মিশর অভিযানে আসেন । অ্যান্টনি মিশরের সিংহাসন লাভের উদ্দেশ্যে ক্লিওপেট্রাকে বিবাহ ( ৩৬ খ্রিস্টপূর্ব ) করেন । ক্লিওপেট্রা মার্ক অ্যান্টনির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে মিশরের স্বাধীনতা রক্ষার চেষ্টা করেন ।  

অ্যাকটিয়ামের যুদ্ধে সম্পূর্ণ পরাজয় : ক্লিওপেট্রা ও অ্যান্টনির মিলিত বাহিনী শীঘ্রই অ্যাকটিয়ামের যুদ্ধে রােমান শাসক অক্টাভিয়াস সিজারের মুখােমুখি হয় । ক্লিওপেট্রা অ্যাকটিয়ামের যুদ্ধে পরাজয়ের সম্মুখীন হয়ে সৈন্যদল নিয়ে পিছিয়ে এলেও অ্যান্টনিও সেনাদলকে ফেলে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসেন । ফলে রােমান শাসক অক্টাভিয়াসের বাহিনী যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে জয়লাভ করে (৩১ খ্রিস্টপূর্ব )। এর ফলে মিশরের স্বাধীনতা লুপ্ত হয় এবং মিশর রােমান সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত হয় । 


উপসংহার : এরপর অক্টাভিয়াস সিজার রানি ক্লিওপেট্রার দুই সন্তানকে হত্যা করেন এবং ক্লিওপেট্রাকে বিবাহ করতে চান । কিন্তু ক্লিওপেট্রা এই বিবাহে অসম্মত হন এবং আত্মহত্যার পথ বেছে নেন । তিনি ৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ১২ আগস্ট ‘অ্যাসপ ’ (কেউটে জাতীয় ) নামে বিষাক্ত সাপের কামড়ে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন ।






বুধবার, ২২ জুন, ২০২২

রানি দুর্গাবতীর পরিচয় ও কার্যাবলি আলােচনা করাে ।

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer রানি দুর্গাবতীর পরিচয় ও কার্যাবলি আলােচনা করাে rani durgabotir porichoy o karjaboli alochona koro

উত্তর : দুর্গাবতী ছিলেন চান্দেল্ল বংশীয় রাজপুত অধিপতি মাহোবা র কন্যা । তিনি ছিলেন একাধারে বুদ্ধিমতী ,সাহসী , দেশপ্রেমিক ও সংস্কৃতিমনস্ক । তিনি গন্ডােয়ানার শাসক দলপত শাহের সঙ্গে বিবাহ করেন । 

শাসনভার গ্রহণ : গন্ডােয়ানার রাজা দলপৎ শাহের মৃত্যুর পর তার নাবালক পুত্র বীরনারায়ণ সেখানকার সিংহাসনে বসলে তার অভিভাবক হিসেবে বিধবা রানি দুর্গাবতী গন্ডােয়ানা শাসন করতে থাকেন ( ১৫৫০ - ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দ ) । রানি দুর্গাবতী দ্রুত রাজ্যের সব শ্রেণির মানুষের শ্রদ্ধা ও সমর্থন লাভ করেন । 

বাজ বাহাদুরের আক্রমণ রোধ : দুর্গাবতীর রাজত্বের প্রথম দিকে আফগান নেতা বাজ বাহাদুর গন্ডােয়ানা আক্রমণ করেন । কিন্তু দুর্গাবতী দক্ষতার সঙ্গে বাজ বাহাদুরের আক্রমণ প্রতিহত করেন । পরবর্তীকালেও বাজ বাহাদুর কয়েকবার গন্ডােয়ানা আক্রমণ করে রানি দুর্গাবতীর বাহিনীর কাছে পরাজিত হন ।   

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দক্ষতা : দুর্গাবতী প্রতিবার জয়লাভ করলেও যুদ্ধে বিপুল অর্থ ব্যায়ের ফলে গন্ডােয়ানার রাজকোশ প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে । দুর্গাবতী অভিযান চালিয়ে ক্ষুদ্র জমির মালিকদের কাছ থেকে বাড়তি রাজস্ব ও অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের নির্দেশ দেন । ফলে শীঘ্রই গন্ডােয়ানার রাজকোশ পূর্ণ হয়ে যায় । 
আকবরের আক্রমণের মােকাবিলা : গন্ডােয়ানার বিপুল অর্থসম্পদ ও ঐশ্বর্য মােগল সম্রাট আকবরকে প্রলুব্ধ করে । এজন্য সম্রাট আকবর ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি আসফ খাঁর নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী গন্ডােয়ানা অভিযানে পাঠান । যুদ্ধে দুর্গাবতীর পরাজয় হলেও তাঁর সংশয়াতীত স্বাধীনতাস্পৃহা , বীরত্ব ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল । 

i) দুর্গাবতীর প্রতিরােধ : বিশাল মােগল বাহিনীর তুলনায় রানি দুর্গাবতীর সেনাবাহিনী ছিল নিতান্তই ক্ষুদ্র । তা সত্ত্বেও দুর্গাবতীর নেতৃত্বে এই বাহিনী অসীম সাহস ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লড়াই করে নররাই - এর যুদ্ধে ( ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে ) প্রথমদিকে কয়েকবার মােগল বাহিনীকে পিছু হঠতে বাধ্য করেন । 

ii) পরিণতি : যুদ্ধের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে রানি দুর্গাবতী মােগল বাহিনীর তীরের আঘাতে দারুণভাবে আহত হন । শেষপর্যন্ত পরাজয় নিশ্চিত জেনে তিনি অপমানিত হয়ে বাঁচার চেয়ে মৃত্যুকেই শ্রেয় বলে গ্রহণ করে নিজের ছুরির আঘাতে আত্মহত্যা করেন । গন্ডােয়ানার একাংশ মােগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং অপর অংশে দুর্গাবতীর বংশধর চন্দ্র শাহকে দেওয়া হয় । চন্দ্র শাহ মােগলদের হাতের পুতুল হয়ে শাসন পরিচালনা করতে থাকেন । 

উপসংহার : রানি দুর্গাবতীর বিরুদ্ধে মােগল আক্রমণ ছিল মােগল বাহিনীর নগ্ন সাম্রাজ্যবাদ ও চূড়ান্ত অর্থলিপ্সার সুস্পষ্ট উদাহরণ । দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রবল শক্তিধর মােগল বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে লড়াই করেও রানি দুর্গাবতী যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন তা ইতিহাসে অত্যন্ত দুর্লভ ।




মঙ্গলবার, ২১ জুন, ২০২২

প্রাচীন ভারতে নারীশিক্ষার বর্ণনা দাও ।

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer প্রাচীন ভারতে নারীশিক্ষার বর্ণনা দাও prachin bharote narisikkhar bornona dao


উত্তর : প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায় বিভিন্ন যুগের সমাজে নারীর মর্যাদার উন্নতি বা অবনতি যাই ঘটুক না কেন , প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন যুগে ভারতীয় নারীর শিক্ষাগ্রহণের বিষয়টি মােটামুটিভাবে অব্যাহত ছিল । বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে পরবর্তী দীর্ঘ সময়ের ভারতের নারীশিক্ষা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায় ।  

ঋগবৈদিক যুগ : ঋগবৈদিক যুগে নারীশিক্ষারও যথেষ্ট সুযােগ ছিল । ধর্মচর্চা, চরিত্রগঠন , ব্যক্তিত্বের বিকাশ প্রভৃতি ছিল এই যুগের শিক্ষার উদ্দেশ্য । এযুগে মমতা , ঘােষা , লােপামুদ্রা , বিশ্ববারা , বিশাখা প্রমুখ বিদুষী নারীর কথা জানা যায় । এযুগের নারীরা বেদের অনেক স্তোত্রও রচনা করেছিলেন । 


পরবর্তী বৈদিক যুগ : সামগ্রিকভাবে পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীর মর্যাদা হ্রাস পেলেও নারীশিক্ষা ভালােভাবেই চালু ছিল । এযুগে কোনাে কোনাে নারী উচ্চশিক্ষায় অগ্রণী ছিলেন । এযুগের যে সকল নারী বিবাহের আগে পর্যন্ত বিদ্যাচর্চা করতেন ,তাদের ‘সদ্যোদ্বাহা’এবং যাঁরা আজীবন অবিবাহিত থেকে ধর্ম ও দর্শন চর্চা করে জীবন কাটিয়ে দিতেন, তাদের ‘ব্ৰহ্ববাদিনী’ বলা হত । এযুগের বিখ্যাত বিদুষী নারী ছিলেন গার্গী , মৈত্রেয়ী প্রমুখ । 


মহাকাব্য ও প্রতিবাদী ধর্মের যুগ : মহাকাব্যের যুগে নারীর মর্যাদা হ্রাস পেলেও এযুগের বহু নারী বিদ্যাচর্চা করতেন । মহাভারতে দ্রৌপদীকে ‘পণ্ডিতা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে । এযুগের অনেক নারী সামরিক শিক্ষা গ্রহণ করতেন । বিনয়পিটকে বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদের অক্ষর জ্ঞান অর্জনকে নিষিদ্ধ করা হয়নি । এযুগের নারীরা সংস্কৃত কাব্য ও নাটকও রচনা করেছেন । ভিক্ষুণীদের রচিত সংগীতগুলি ‘থেরীগাথা’ গ্রন্থে সংকলিত আছে । চন্দনা, জয়ন্তী প্রমুখ ছিলেন এযুগের উচ্চশিক্ষিতা নারী । 

মৌর্য যুগ : মৌর্য যুগে শিক্ষিত নারীরা রাজকার্যেও অংশ নিতেন । সমকালীন সংস্কৃত সাহিত্যে এমন বহু নারীর উল্লেখ আছে যারা লিখতে , পড়তে ও সংগীত রচনা করতে পারতেন । কোনাে কোনাে নারী চিত্রশিল্পেও দক্ষ ছিলেন । 


মৌর্য-পরবর্তী যুগ : মৌর্য পরবর্তী যুগে অনেক মহিলা উচ্চশিক্ষা লাভ করতেন । পাণিনি বলেছেন যে , এই সময় নারীরা বেদ অধ্যয়ন করতেন । কাত্যায়ন তার ‘কার্তিক’ গ্রন্থে অধ্যাপিকা বােঝাতে ‘উপাধ্যায়া’ বা ‘উপাধ্যায়ী’ শব্দ ব্যবহার করেছেন । এই সময়ে অনেক অভিজাত মহিলা বৈদিক স্তোত্র, সংস্কৃত কাব্য ও নাটক রচনা করতেন । 


গুপ্তযুগ : বিভিন্ন সাহিত্য থেকে গুপ্তযুগের নারীরা , ইতিহাস ও কাব্যচর্চা করত বলে সমকালীন সাহিত্য থেকে জানা যায় । শাস্ত্রজ্ঞান এযুগের নারীর বােধবুদ্ধিকে তীক্ষ করত বলে ব্যাৎসায়ন উল্লেখ করেছেন । তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে ,আদর্শ পত্নীকে সুশিক্ষিত হতে হবে এবং তাকে সাংসারিক আয়ব্যয়ের হিসাব রাখতে হবে । গুপ্তযুগে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা প্রভাবতী গুপ্তার মতাে কাশ্মীর, উড়িষ্যা ও অন্ধ্রের নারীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও প্রশাসনিক কার্য পরিচালনা করতেন । অবশ্য এযুগে সাধারণ দরিদ্র নারীদের শিক্ষার সুযােগ বিশেষ ছিল না ।

হর্ষবর্ধনের আমল : হর্ষবর্ধনের আমলে চিত্রকলা , নৃত্য,সংগীত প্রভৃতি শিক্ষার প্রচলন ছিল । হর্ষবর্ধনের ভগ্নি রাজ্যশ্রী নিয়মিত সংগীত , নৃত্য ও অন্যান্য কলার চর্চা করতেন বলে বানভট্ট উল্লেখ করেছেন । নারীরা সাধারণত পিতৃগৃহেই শিক্ষালাভ করত । 

উপসংহার : ঋগবৈদিক যুগে নারীরা যে মর্যাদার অধিকারী ছিলেন , তা পরবর্তী বিভিন্ন যুগে বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছিল । নারীসমাজে শিক্ষাগ্রহণের ধারা অব্যহত থাকলেও মর্যাদায় তারা পুরুষের সমকক্ষ হতে পারেনি । তা ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ নারীরা বিশেষত দরিদ্র ঘরের নারীরা শিক্ষাগ্রহণের সুযােগ থেকে বঞ্চিতই থেকে গিয়েছিল ।



সোমবার, ২০ জুন, ২০২২

প্রাচীন ভারতে ‘ বর্ণ ’ ও ‘ জাতি ' প্রথা সম্পর্কে বিশদভাবে আলােচনা করাে ।

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer প্রাচীন ভারতে বর্ণ ও জাতি প্রথা সম্পর্কে বিশদভাবে আলােচনা করাে prachin bharote borno o jati protha bishodvabe alochona koro


উত্তর : বিতর্ক : আর্যরা ভারতে আসার পূর্বে তাদের সমাজে বর্ণ ও জাতিব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল কি না তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে । অনেকেই মনে করেন যে , আর্যদের ভারতে আগমনকালে বৈদিক সমাজে বর্ণব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল না।  পরবর্তীকালে আর্যরা ভারতের অভ্যন্তরে সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে বসবাস শুরু করলে স্থানীয় কৃষ্ণকায় অনার্যদের থেকে নিজেদের পৃথক রাখার উদ্দেশ্যে আর্য সমাজে বর্ণব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটে । অন্যদিকে অধ্যাপক সুনীল চট্টোপাধ্যায়ের মতে , “ভারতে বর্ণ বৈষম্যের সূচনা , ঋগবৈদিক যুগের পূর্বে, আর্য ইতিহাসের ইন্দো ইরানীয় পর্বে হয়েছিল ।” 
বর্ণপ্রথার সূচনা : বৈদিক আর্যরা বৈবাহিক সম্পর্ক, সামাজিক আচার আচরণ প্রভৃতি বিষয়গুলি নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার উদ্যোগ নেয় । আর্য সমাজে বিভিন্ন সামাজিক বিধিনিষেধ চালু হয় এবং পেশাগত ভিত্তিতে আর্যদের সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হয় । এইভাবে আর্য সমাজে বংশানুক্রমিক বর্ণপ্রথার উদ্ভব ঘটে । তবে বৈদিক যুগে বর্ণভেদ প্রথার উদ্ভব ঘটলেও তখন জাতিভেদপ্রথার অস্তিত্ব ছিল কিনা তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে । 

বর্ণভেদের কারণ : বৈদিক সমাজে বর্ণপ্রথা চালু হওয়ার বিভিন্ন কারণ ছিল— 

[i] গৌরবর্ণ ও দীর্ঘকায় আর্যরা ভারতের কৃষ্ণবর্ণ ও খর্বকায় অনার্যদের কাছ থেকে নিজেদের পৃথক করার উদ্দেশ্যে আর্য সমাজে বর্ণভেদের প্রয়ােজন অনুভব করে । ঐতিহাসিক রাপসন বলেছেন যে,আর্য সমাজে ‘বর্ণ’ শব্দটি ‘গায়ের রং’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে । আর্যদের গৌরবর্ণ ও অনার্যদের কৃষ্ণবর্ণের পার্থক্য বজায় রাখতে আর্যরা তাদের সমাজে বর্ণভেদ প্রথাচালু করে । 

[ii] অনার্যদের বিরুদ্ধে অবিরাম সংঘর্ষের মাধ্যমে আর্যরা ভারতে বসতির প্রসার ঘটায় । ফলে দীর্ঘ যুদ্ধে লিপ্ত থাকা একজন আর্য পুরুষের পক্ষে কৃষি , শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের কাজে যুক্ত থাকা সম্ভব ছিল না । এই জন্য সমাজে বিভিন্ন পেশা ও পেশার ভিত্তিতে বর্ণপ্রথার সূচনা হয় । 

চতুর্বর্ণ প্রথা : আর্যদের পেশার ভিত্তিতে বৈদিক সমাজে চারটি পৃথক বর্ণের সূচনা হয় । ঋগবেদের দশম মণ্ডলের পুরুষসুক্তের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে যে ,আদি পুরুষ ব্ৰত্মার মুখমণ্ডল থেকে ব্রাত্মণ,বাহুদ্বয় থেকে ক্ষত্রিয় , উরুদেশ থেকে বৈশ্য ও চরণযুগল থেকে শূদ্রের উৎপত্তি হয়েছে । এইভাবে আর্য সমাজে ব্রাত্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য ও শূদ্র — এই চারটি পৃথক বর্ণের সৃষ্টির কথা জানা যায় । আর্যরা ব্রাত্মণ,ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য — এই তিনটি বর্ণে বিভক্ত হয় এবং অনার্যরা শূদ্রবলে পরিচিত হয় । উৎপত্তি অনুসারে ব্রাত্মণদের স্থান সবার ওপরে এবং শূদ্রদের স্থান সবার নীচে ছিল । 

চতুর্বর্ণের পেশা : আর্যদের চতুর্বর্ণব্যবস্থায় প্রতিটি বর্ণের জন্য পৃথক পৃথক পেশা সুনির্দিষ্ট করা হয় । 
[i] বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাত্মণদের কাজ ছিল যাগযজ্ঞ , পূজার্চনা ও অধ্যয়ন -অধ্যাপনা করা ।

[ii] ক্ষত্রিয়দের কাজ ছিল দেশ রক্ষা করা ।

[iii] বৈশ্যদের কাজ ছিল ব্যাবসাবাণিজ্য , কৃষি ও পশুপালন করা । 

[iv] শূদ্রদের কাজ ছিল উপরােক্ত তিন শ্রেণির সেবা করা । ভৃত্য , কায়িক শ্রমজীবী ও কৃষকরা ছিল শূদ্র বর্ণের অন্তর্ভুক্ত । 

ঋবৈদিক যুগে জাতি প্রথা : পরবর্তীকালে বৈদিক সমাজে মানুষ আরও নতুন নতুন পেশার সঙ্গে যুক্ত হলে পূর্বতন চতুর্বর্ণ প্রথায় নানা সংমিশ্রণের মাধ্যমে বিভিন্ন নতুন মিশ্রবর্ণের সৃষ্টি হয় । এই সময় থেকে বর্ণপ্রথা ক্রমে জাতিপ্রথার দিকে অগ্রসর হতে থাকে । কেউ কেউ মনে করেন যে , ঋবৈদিক যুগেই আর্য সমাজে জাতিভেদপ্রথার সূচনা হয় । কেননা , কোনাে বর্ণের সন্তান জন্মগতভাবে তার পূর্বপুরুষের বর্ণই গ্রহণ করত । এইভাবে চারটি বর্ণ ক্রমে চারটি জাতিতে পরিণত হয় । 

যজুর্বেদের যুগে জাতি প্রথা : ড .এ এল বাসাম মনে করেন যে , ঋবৈদিক যুগের সমাজে শ্রেণিবৈষম্য থাকলেও জাতিবৈষম্য ছিল না । তবে বর্ণ ও জাতিভেদপ্রথার মধ্যে যােগসূত্র বর্তমান এবং জাতিভেদপ্রথার উদ্ভবে বর্ণ প্রথার যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল । পরবর্তী বৈদিক যুগে পূর্ব ভারতে আর্য বসতির প্রসার ঘটতে থাকলে সমাজে নানা জটিলতা দেখা দেয় । তখনই , অর্থাৎ পরবর্তী বৈদিক যুগের সমাজে জাতি প্রথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে বলে অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন । 


জাতি প্রথার উপাদান : পণ্ডিতগণ মনে করেন যে,ঋবৈদিক সমাজে পেশাগত ভিত্তিতে যে বর্ণ প্রথার উদ্ভব ঘটেছিল , পরবর্তীকালে তা থেকেই জাতিভেদপ্রথার উদ্ভব ঘটে । ঐতিহাসিক ড. ডি ডি কোশাম্বী মনে করেন যে ,ঋগ্‌বৈদিক যুগের পরবর্তীকালে আর্য সমাজের বিভিন্ন উপজাতি প্রথা ভেঙে পড়তে থাকে এবং তখনই জাতিপ্রথার আত্মপ্রকাশ ঘটে । 


উপসংহার : উৎপত্তির পর থেকে ভারতের জাতিপ্রথায় নানা বিবর্তন ঘটে । বৈদিক যুগে চারটি বর্ণ চারটি জাতিতে পরিণত হয় । বৈদিক সমাজের বাইরে ‘ব্রাত্য’ ও ‘নিষাদ’ নামে দুটি জাতির অস্তিত্বের  কথা জানা যায় । প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের যুগে জাতি প্রথা সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করে এবং বংশানুক্রমিক হয়ে ওঠে । মেগাস্থিনিস মৌর্য যুগে ভারতে সাতটি জাতির উল্লেখ করেছেন । এগুলি হল—
[i] দার্শনিক ।

[ii] কৃষক ।

[iii] পশুপালক ও শিকারি ।

[iv] কারিগর ও শিল্পী ।

[v] সৈনিক ।

[vi] গুপ্তচর বা পরিদর্শক ।

[vi] মন্ত্রণাদাতা । 

পরবর্তীকালে আরও নতুন নতুন জাতির উদ্ভব ঘটে ।



রবিবার, ১৯ জুন, ২০২২

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতে নব্য ধর্মীয় আন্দোলনের উত্থানের প্রেক্ষাপট আলােচনা করাে ।

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতে নব্য ধর্মীয় আন্দোলনের উত্থানের প্রেক্ষাপট আলােচনা করাে khrishtopurbo shoshto shotoke uttor bharote nobbo dhormiyo andoloner uthaner prekhapot alochona koro

উত্তর : আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসা : বৈদিক যুগের শেষ দিকে মানুষের মনে আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধিপায় । ‘শ্রমণ’ ও ‘পরিব্রাজক’ নামে দুই সন্ন্যাসী গােষ্ঠীর প্রভাবে মানুষ কুসংস্কারপূর্ণ বৈদিক ধর্মের শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে । 
যাগযজ্ঞে জটিলতা বৃদ্ধি : বৈদিক যুগের শেষ দিকে ব্রাত্মণ্যধর্ম যাগযজ্ঞ ও আচারসর্বস্ব হয়ে পড়ায় ধর্মাচরণের পদ্ধতি সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে । উপরন্তু এই ব্যয়বহুল ধর্মাচরণ পদ্ধতির ব্যয় বহন করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে । 

ধর্মাচরণের অধিকার হ্রাস : পরবর্তী বৈদিক যুগে প্রচলিত ব্রাত্মণ্যধর্মে বৈশ্য ও শূদ্র শ্রেণির ধর্মাচরণের অধিকার বিশেষভাবে হ্রাস পায় । নারীরাও বেদ পাঠের অধিকার হারিয়ে ক্ষুদ্ধ হয় । 


কৃষকদের অবস্থার পরিবর্তন : খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে কৃষি উৎপাদন অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধি পায় । কিন্তু বৈদিক যাগযজ্ঞে প্রচুর পরিমাণ গাে-বলি শুরু হলে নতুন কৃষি অর্থনীতি সমস্যার সম্মুখীন হয় । এই সময় গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীর ‘জীবে দয়া’ এবং ‘অহিংসা’র বাণী প্রচার করলে কৃষকশ্রেণি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং আচার সর্বস্ব ব্রাত্মণ্য ধর্মব্যবস্থার পরিবর্তনে আগ্রহী হয়ে ওঠে ।

ব্যবসায়ী শ্রেণির উচ্চাকাকাঙ্খা : এই সময় নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বহু নতুন নগর প্রতিষ্ঠিত হয় । ফলে ব্যাবসা বাণিজ্য বৃদ্ধি পায় । বাণিজ্য বৃদ্ধির ফলে বৈশ্য শ্রেণির আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটে এবং তারা সামাজিক মর্যাদালাভের জন্য ব্রাত্মণ্যবাদের অবসান কামনা করে । 


ব্যয়বহুল আচার অনুষ্ঠান : বৈদিক ব্রাত্মণ্য ধর্ম ছিল আড়ম্বর সর্বস্ব এবং ব্যয়বহুল । ধর্মের প্রধান অঙ্গ ছিল যজ্ঞ। যত্ত পরিচালনার জন্য সাধারণ মানুষকে প্রচুর অর্থ ব্যয়করতে বাধ্য করা হত । তাই তারা নতুন ধর্মে আকৃষ্ট হয় । 


গণরাজ্য প্রতিষ্ঠা : খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতীয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু গণরাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয় । সেই গণরাজ্যগুলিতে মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতার সুযােগ এবং উপজাতীয় রীতিনীতির অনুসরণে বর্ণাশ্রমবিহীন সমাজের প্রতিষ্ঠা নব্য ধর্ম আন্দোলনের রাজনৈতিক পটভূমি তৈরি করেছিল । 

নতুন সমাজ স্থাপন : ব্রাত্মণ্যধর্মের রক্ষণশীলতার পরিবর্তে নবগঠিত গণরাজ্যগুলিতে উপজাতীয় রীতিনীতি অনুযায়ী বর্ণাশ্রম বিহীন নতুন সমাজ স্থাপিত হয় । সেখানে ব্রাত্মণদের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন বা বৈদিক রীতি মান্য করা বাধ্যতামূলক ছিল না । 
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা : গণরাজ্যগুলিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ও স্বাধীন মতপ্রকাশের অবাধ সুযােগ ছিল । এই উদার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মহাবীর বা গৌতম বুদ্ধ ব্রাত্মণ্যবাদের অসাম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে সমাজসংস্কারের ডাক দিয়েছিলেন ।  


ব্রাত্মণ সম্প্রদায়ের একাধিপত্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ : বর্ণবিভক্ত বৈদিক সমাজে ব্রাত্মণের স্থান ছিল সবার ওপরে — সমাজ ও রাষ্ট্রে তারা বহু সুযােগসুবিধার একচেটিয়া অধিকারী ছিল । অন্যান্য শ্রেণির মধ্যে ব্রাক্ষ্মণদের এই একচেটিয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছিল । 

ব্রাহ্রণ ক্ষত্রিয় দ্বন্দ্ব : যুদ্ধে অংশগ্রহণ , রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা ও প্রশাসন পরিচালনার মতাে গুরুদায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও সমাজ ও রাষ্ট্রে ব্রাত্মণদের তুলনায় ক্ষত্রিয়দের মর্যাদা ও অধিকার ছিল কম । এই পরিস্থিতি রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী ক্ষত্রিয়দের কাছে ক্রমেই অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায় এবং এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে নব্য ধর্ম আন্দোলনে । 
বৈশ্য ও শূদ্রদের ক্ষোভ : সম্পদ সৃষ্টি ও রাষ্ট্রে আর্থসামাজিক দায়দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও বৈদিক সমাজ বা রাষ্ট্র বৈশ্য ও শূদ্রদের কোনােরকম মর্যাদা দেয়নি । এই শ্রেণিবৈষম্য তাদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল । বৌদ্ধ ও জৈন , এই দুই নব্য ধর্মে বর্ণভেদহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার থাকায় , বৈশ্য ও শূদ্ররা এই দুই ধর্মের  প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল ।


ব্রাক্ষ্মণ্য সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নারীজাতির ক্ষোভ : ব্রাত্মণ সমাজে নারীজাতিকে সম্মানের চোখে দেখা হত না । বুদ্ধ ও মহবীর নারীজাতি , এমনকি সমাজচ্যুতা নারীদের মর্যাদা দেওয়ায় তারাও এই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয় । 

[          ]  খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মানুষের মনে বুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ ঘটে । এর ফলস্বরূপ এই সময় জন্মান্তরবাদ, কর্মফল প্রভৃতি ধর্মাচরণকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে বলা হয় যে, সব মানুষকেই কর্মফল ভােগ করতে হবে । 

[       ] বৈদিক আর্যদের ভাষা সংস্কৃত হওয়ার জন্য তা সাধারণ মানুষের বােধগম্যের বাইরে ছিল । অন্যদিকে বুদ্ধদেব আঞ্চলিক পালি ভাষায় ধর্মপ্রচার করায় তা সর্বসাধারণের সহজবােধ্য হয় । 


মূল্যায়ণ : ধর্মকে মানুষের জীবনে সহজসরল রূপ দেওয়ার জন্য নব্য ধর্মের উত্থান ঘটে । নব্য ধর্মের মধ্য দিয়ে মানুষ এক মানবতাবাদী জীবনমুখী ধর্মের অনুসন্ধানে উগ্রীব হয়ে ওঠে । অধ্যাপক এ. এল . ব্যাসামের মতে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে , ‘বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক আলােড়নের মাধ্যমে ভারতের এক মহান ঐতিহাসিক যুগের সূচনা ঘটে ।’