শুক্রবার, ১ জুলাই, ২০২২

সুমেরীয় সভ্যতার নগর পরিকল্পনা ও জীবনযাত্রা কেমন ছিল ?

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer সুমেরীয় সভ্যতার নগর পরিকল্পনা ও জীবনযাত্রা কেমন ছিল sumeriyo sobhotar nogor porikolpona o jibonyatra kemon chilo

উত্তর : সুমেরীয় সভ্যতার নগর পরিকল্পনা ।

[      ] নির্মাণ পরিকল্পনা : সুমেরীয় সভ্যতার বিভিন্ন নগর ও জনপদগুলি সুনির্দিষ্টভাবে এবং পরিকল্পনামাফিক নির্মিত হয়েছিল । এক একটি জনপদে অসংখ্য বাড়ি,মন্দির ও রাস্তাঘাট নির্মিত হত । উর , উরুক ,লাগাস , কিশ , এরিডু , আক্কাদ প্রভৃতি শহরে খননকার্য চালিয়ে এই সভ্যতার নগরপরিকল্পনা সম্পর্কে বহু তথ্য জানা গেছে । 


[         ] নগরের নিরাপত্তা : সুমেরের বিভিন্ন নগরের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ লেগে থাকত । তাই সুরক্ষার উদ্দেশ্যে নগরগুলি উঁচু প্রাচীর ও চওড়া খাল দিয়ে ঘেরা থাকত । তা ছাড়া নগরগুলিতে সর্বদা সৈন্যবাহিনীর পাহারার ব্যবস্থা ছিল । 


[        ] ঘরবাড়ি : সুমেরীয় অঞ্চলে পাথর বা কাঠের জোগান কম থাকায় অধিকাংশ ঘরবাড়ি ইট দিয়ে নির্মাণ করা হত । এক্ষেত্রে পােড়া ইট বা রােদে শুকানাে ইট ব্যবহৃত হত । বন্যার হাত থেকে রক্ষা পেতে পােড়া ইটের বাড়ি নির্মাণ করা হত । বড়াে অট্টালিকাগুলিতে গম্বুজ ও খিলানের ব্যবহার করা হত । সুমেরবাসী একতল এবং দ্বিতল —উভয় ধরনের গৃহ তৈরি করত । 


[          ] রাস্তাঘাট : সুমেরীয় সভ্যতার বাড়িগুলাের ধারেই ছিল ইট দিয়ে বাঁধানাে সরু সরু রাস্তা । রাস্তা ও বাড়িগুলাের মধ্যে ব্যবধান ছিল খুবই কম । রাস্তাঘাটগুলি যথেষ্ট পরিষ্কার - পরিচ্ছন্ন ছিল । তবে সমসাময়িক হরপ্পা সভ্যতার মতাে সুমেরীয় সভ্যতায় রাস্তার ধারে সুপরিকল্পিত পয়ঃপ্রণালী ছিল না । 

[        ] শাসন কাঠামাে : সুমেরীয় সভ্যতায় যুদ্ধবাদী রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল । রাজার নেতৃত্বে অভিজাতদের নিয়ে গঠিত কাউন্সিল পুরােহিত প্রশাসন পরিচালনা করত । এই কাজে তারা বিভিন্ন আমলা , সেনাপতি , প্রহরী, জল্লাদ প্রভৃতির সহায়তা নিত । ফলে এখানকার নাগরিকরা যথেষ্ট সুশাসন ও স্বাধীনতা পেত । 



[         ]  সুমেরীয় সভ্যতায় বসবাসকারী মানুষরা এক উন্নত জীবনযাত্রা গড়ে তােলে । তাম্র -ব্রোঞ্জ যুগের এই সভ্যতায় সমাজ ,সংস্কৃতি ও অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে তারা অগ্রগতি ঘটিয়েছিল । 



[         ] সামাজিক জীবন : সুমেরীয় সভ্যতায় মন্দিরকে কেন্দ্র করে একটি সুসংবদ্ধ সমাজ গড়ে উঠেছিল । পুরােহিত , কারিগর , বণিক , মালি ও অন্যান্য পেশার বিভিন্ন মানুষ এই মন্দির সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হত । সুমেরীয় সমাজে লুগাস নামে ভূস্বামীদের উত্থান ঘটেছিল । 


[        ] অর্থনৈতিক জীবন : সুমেরীয় সভ্যতার মানুষ কৃষি, পশুপালন , বাণিজ্য প্রভৃতি বিষয়ে পারদর্শী ছিল । 
i) কৃষি : কৃষি ছিল সুমেরের অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা । তারা নদীতে বাঁধ দিয়ে সেখান থেকে খাল কেটে কৃষিজমিতে জলসেচের ব্যবস্থা করত । টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী উর্বর অঞলে তারা গম , যব , বিভিন্ন সবজি প্রভৃতি ফসল ফলাত । সুমেরীয়দের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিল তাদের ‘জীবনবৃক্ষ’ , খেজুর গাছ । 


ii) পশুপালন : সুমেরের বাসিন্দারা গােরু, ছাগল , ভেড়া , প্রভৃতি পশু পালন করত । টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ তৃণভূমি অঞ্চলে এই সকল গৃহপালিত পশু চড়ে বেড়াত ।

iii) বাণিজ্য : ব্যাবসাবাণিজ্য ছিল সুমেরের অধিবাসীদের গুরুত্বপূর্ন পেশা । স্থলপথে পশুতে টানা গাড়ি ও জলপথে পাল তোলা নৌকার সাহায্যে সুমেরের দেশীয় ও বৈদেশিক বাণিজ্য চলত বাণিজ্যে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে প্রথমদিকে খাদ্যশস্য ও পরবর্তীকালে রৌপ মুদ্রা ব্যবহৃত হত ।



iv) অন্যান্য জীবিকা : এ ছাড়াও সুমেরের অধিবাসীরা সৈনিক , পুরােহিত , রাজকর্মচারী প্রভৃতি পেশাও গ্রহণ করত । বহু মানুষ মাছ ধরার কাজেও যুক্ত ছিল । 


[       ] সাংস্কৃতিক জীবন : সুমেরীয় সভ্যতার অধিবাসীরা শিক্ষা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতি ঘটিয়েছিল । 


1) শিক্ষা : এই সভ্যতায় বিদ্যাচর্চার যথেষ্ট প্রচলন ছিল । পণ্ডিতদের মতে , সুমেরীয়রাই সর্বপ্রথম লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করে । নিপুর শহরে এই সভ্যতার একটি গ্রন্থাগার আবিষ্কৃত হয়েছে । এখানে কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা অন্তত পাশ হাজার পােড়ামাটির ফলক মিলেছে । 

2) সাহিত্য : এই সভ্যতার মানুষেরা ধর্মসাহিত্য, রাজকাহিনি ও মহাকাব্য রচনা করেছিল । এই প্রসঙ্গে উরুকের সুমেরীয়রা রাজা গিলগামেশের বীরত্ব ,আন্তরিকতা ও ব্যর্থতার কাহিনিকে অবলম্বন করে ‘গিলগামেশ’ মহাকাব্যটি বিশেষ উল্লেখযােগ্য ।


3) শিল্পকলা : সুমেরীয়দের জীবনযাত্রায় শিল্পকলার বিশেষ গুরুত্ব ছিল । তারা কারুশিল্প ও চারুশিল্প — উভয় ক্ষেত্রেই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল । নগর -মন্দির ‘জিগুরাত’ - এর মতাে স্থাপত্য কর্ম, বাড়ি ও মন্দিরের জীবজন্তু, গাছপালা -সহ বিভিন্ন প্রকার চিত্রকলা , মৃৎশিল্প , ধাতু শিল্প, বস্ত্রশিল্প ইত্যাদি সুমেরীয়বাসীর উন্নত শিল্পকলার নিদর্শন । 

4) বিজ্ঞান : সুমেরীয়রা বিজ্ঞান -ভাবনায়ও এগিয়েছিল । পরিবহণের কাজে রথের প্রচলন , হিসাব -নিকাশের কাজে যােগ ,বিয়ােগ , গুন, ভাগ , বর্গমূল, ঘনমূল -সহ নানান গাণিতিক প্রয়োগ জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা , চিকিৎসার কাজে প্রয়ােজনীয় ঔষধের ব্যবহার তাদের উন্নত বিজ্ঞানচর্চার পরিচয় দেয় । 

 
[         ] ধর্মীয় জীবন : সুমেরীয়দের জীবনযাত্রায় ধর্মের বিশেষ গুরুত্ব ছিল । সেখানে বহু দেবদেবীর আরাধনা প্রচলিত ছিল । সুমেরের প্রতিটি নগরেই পৃথক পৃথক নগরদেবতা ছিলেন । সুমেরীয়বাসী সুউচ্চ স্থানের ওপর বিভিন্ন দেবদেবীর মন্দির নির্মাণ করত যা ‘জিগুরাত’ অর্থাৎ স্বর্গের পাহাড় নামে পরিচিত ছিল । 


উপসংহার : প্রাচীনকালে এক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে সুমেরীয়রা টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে এই উন্নত নগর সভ্যতা গড়ে তােলে । এই সভ্যতাতে নগরজীবনের ছাপ স্পষ্ট । সুমেরের নগরের পরিকল্পনা ও নাগরিক জীবনযাত্রায় যে মান লক্ষ করা যায় , তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে ।







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন