পলিস বা নগর রাষ্ট্র কী ? পলিসের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো ।
উত্তর : গ্রিক ভাষায় ‘ পলিস ’ শব্দটির দ্বারা ‘নগর’ এবং ‘রাষ্ট্র’ উভয়কেই বােঝানাে হয়ে থাকে ।
i) নগর : পলিসকে এই অর্থে ‘নগর’ বলা হয় যে, এখানে সকল পলিসবাসীর জন্য বাজার এবং নাগরিকদের সমবেত হওয়ার জায়গা থাকত ।
ii) রাষ্ট্র : ‘পলিস’ কে ‘রাষ্ট্র’ বলার কারণ হল , রাজকীয় কাজকর্ম , প্রশাসন পরিচালনা , বিচারকার্য সব এখান থেকেই পরিচালনা করা হত । অধ্যাপক কিটো বলেছেন যে, সাধারণ পলিস ঠিক শহরের মতাে ছিল না ,আবার তা রাষ্ট্রের চেয়েও বেশি কিছু ছিল ।
[ ] ভূখণ্ডের জনসমষ্টি : ‘পলিস' বলতে নির্দিষ্ট ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মরত একটি জনগােষ্ঠীকে বােঝাত । প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসবিদ থুকিডিডিস বলেছেন , “Men are the polis” , ‘ অ্যাকারনিয়াস ’ নাটকের একটি উক্তি— “হে পলিস তুমি দেখতে পাচ্ছ ;” কিংবা ‘অয়দিপাউস’ নাটকের “আমি একা নয়, সমগ্র পলিস শুনেছে” —এই উক্তিটির দ্বারাও বােঝা যায় যে এখানে ‘পলিস ’ বলতে সেই ভূখণ্ডের সমগ্র জনগােষ্ঠীকেই উল্লেখ করা হয়েছে ।
[ ] রাজনৈতিক ভিত্তি : প্রাচীন গ্রিক পলিসগুলির একটি রাজনৈতিক ভিত্তি থাকত । যেমন — আরকাডির মতাে গ্রিক সম্প্রদায়ের কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান না থাকায় তারা পলিস বলে গণ্য হত না । তাছাড়া কোনাে অগ্রিক রাষ্ট্র সম্পর্কে ‘পলিস’ শব্দটি ব্যবহার করা হত না ।
[ ] নাগরিক জীবনের সুবিধা : পলিসগুলিতে বড়াে বাড়ি, জিমনাসিয়াম , প্রেক্ষাগৃহ, বাজার প্রভৃতি নাগরিক জীবনের বিশেষ সুযােগসুবিধা থাকত । এই সুযােগসুবিধা না থাকায় পােনােসিয়াস নামক মধ্য গ্রিসের ছােটো শহরটিকে ঐতিহাসিক পেটসেনিয়াস ‘নগর রাষ্ট্র’ বলতে রাজি নন । অ্যারিস্টটলও তার ‘পলিটিক্স’গ্রন্থে – [ i ] স্বাস্থ্য , [ ii ] প্রতিরক্ষা , [ iii] রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ এবং [ iv ] সৌন্দর্য — এই চারটি বিষয়কে নগর রাষ্ট্রের পরিকল্পনায় আবশ্যিক বলে উল্লেখ করেছেন ।
[ ] খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম থেকে চতুর্থ শতকে গ্রিসের ধ্রুপদি যুগে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্র বা পলিসগুলির উদ্ভব হয় । এগুলির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় । যেমন –
ক্ষুদ্রায়তন ও অল্প জনসংখ্যা : গ্রিক পলিসগুলির আয়তন হত খুব ছােটো এবং জনসংখ্যা ছিল খুব কম । অ্যারিস্টটল তার ‘পলিটিক্স’ গ্রন্থে পলিসের আয়তন ক্ষুদ্র হওয়ার কথা বলেছেন । প্লেটো তার ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে বলেছেন যে , একটি আদর্শ পলিসের লােকসংখ্যা হওয়া উচিত ৫০০০ । আসলে এখানে জনসংখ্যা এমন একটা পর্যায়ে থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল যাতে প্রত্যেকেই প্রত্যেককে চিনতে ও জানতে পারে ।
নগর ও গ্রামের সমন্বয় : গ্রিসে পলিস বলতে শুধু ‘নগর -রাষ্ট্র’ ছিল না । সেখানে এথেন্সের মতাে কয়েকটি উন্নত নগরকেন্দ্রিক পলিস ছিল , আবার স্পার্টার মতাে বহু পলিস ছিল যেখানে মানুষ গ্রামে বসবাস করত । আবার অনেক পলিসে নগর ও গ্রাম উভয়ই ছিল ।
জনগণের প্রশাসন : গ্রিক পলিসগুলির শাসন পরিচালনায় জনগণ প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করত । উল্লেখ্য যে , পলিসের প্রশাসনিক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারত শুধুমাত্র নাগরিকরা । বিদেশি ক্রীতদাস ও মহিলারা এই অধিকার পেত না ।
শাসনকাঠামাে : গ্রিসের পলিসগুলিতে গণতান্ত্রিক, অভিজাত তান্ত্রিক , স্বৈরতান্ত্রিক প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের শাসনকাঠামাে চালু ছিল । পলিসের শাসনকাঠামাের প্রধান তিনটি অংশ ছিল , যথা— [i] সমিতি , [ ii ]পরিষদ ও [ iii] ম্যাজিস্ট্রেট ।
গঠন বিন্যাস : প্রতিটি পলিসের নির্দিষ্ট গঠনকাঠামাে ছিল । যেমন — পাহাড়ের শিখরে থাকত শাসনকেন্দ্র বা অ্যাক্রোপলিস ; অধিকাংশ পলিসে থাকত জনসাধারণের জন্য বাজার বা অ্যাগােরা । আর ছিল নগর -প্রাচীরের বাইরে চোরা বা গ্রামীণ অঞ্চল ।
অর্থনৈতিক বৈষম্য : গ্রিসের বিভিন্ন পলিসে বিভিন্ন ধরনের বিকাশ ঘটেছিল । করিন্থের মতাে কোনাে কোনাে পলিস ছিল শিল্প বাণিজ্যে উন্নত , আবার স্পার্টার মতাে পলিসগুলির মানুষ কৃষি বা মন্দিরের আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল । এর ফলে গ্রিসের পলিসগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি হয়েছিল ।
স্বাতন্ত্র্য : প্রতিটি গ্রিক পলিস ছিল স্বাধীন,স্বশাসিত এবং একে অপরের থেকে পৃথক । প্রতিটি পলিসেরই নিজস্ব সরকার , সেনাবাহিনী ও ক্যালেন্ডার থাকত । সম্ভবত পলিসগুলির প্রতিটির পৃথক মুদ্রাব্যবস্থা এবং মানচিত্র ছিল । কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে পলিসগুলির পূজাপদ্ধতিও পৃথক হত ।
উপসংহার : আনুমানিক ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসে ডােরিয়ান বিজয়ের পরবর্তীকালে বিভিন্ন নগরকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পলিস গড়ে উঠতে থাকে । খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে সপ্তম শতকের মধ্যে পলিসগুলি তাদের প্রাথমিক রূপ লাভ করে । প্রথম দিকে ‘পলিস ’ ছিল মূলত গ্রিসের নগর দুর্গ । পরবর্তীকালে গােটা রাষ্ট্র , রাষ্ট্রের মানুষ ও তাদের সংস্কৃতি পলিসের সমার্থক হয়ে ওঠে ।
কোন মন্তব্য নেই