মঙ্গলবার, ৫ জুলাই, ২০২২

গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের কৃতিত্ব আলােচনা করাে ।

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের কৃতিত্ব আলােচনা করাে gupto samrat somudrogupter krititto alochona koro

উত্তর : সমুদ্রগুপ্ত অসংখ্য সফল অভিযান পরিচালনার মধ্য দিয়ে সারা ভারতব্যাপী সাম্রাজ্য গড়ে তােলেন । ঐতিহাসিক এইচ . সি, রায়চৌধুরীর মতে , তাঁর রাজ্যজয়ের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠাকরা । 

i) উত্তর ভারত জয় : সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেণ রচিত এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে জানা যায় যে, সমুদ্রগুপ্ত উত্তর ভারতের ৯ জন রাজাকে পরাজিত করে তাদের রাজ্যগুলি নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন ।   এই ৯ জন রাজা হলেন – (১) রুদ্রদেব ,(২) মতিল , (৩) নাগদত্ত , (৪) চন্দ্রবর্মন, (৫) গণপতিনাগ , (৬) অচ্যুৎ , (৭) নাগসেন , (৮) নন্দিন ও (৯) বলবর্মন । এদের রাজ্যগুলিকে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করার পর সমুদ্রগুপ্ত সেখানে প্রত্যক্ষ শাসন চালু করেন । 


ii) আটবিক রাজ্য জয় : উত্তর ভারত জয়ের পর সমুদ্রগুপ্ত দক্ষিণ দিকের অরণ্যসংকুল আটবিক রাজ্যগুলি জয় করেন । এরাণ শিলালিপি থেকে তার আটবিক রাজ্যজয়ের কথা জানা যায় । এই রাজ্য গুলি জয়ের মধ্য দিয়ে সমুদ্রগুপ্ত দাক্ষিণাত্যে তাঁর অভিযানের পথ প্রশস্ত করেন ।

iii) দক্ষিণ ভারত জয় : দক্ষিণ ভারতে অভিযান চালিয়ে সমুদ্রগুপ্ত সেখানকার ১২ জন রাজাকে পরাজিত করেন । এরা হলেন (১) বিষ্ণুগােপ  (২) হস্তীবৰ্মন (৩) নীলরাজ (৪) উগ্রসেন  (৫) ধনঞ্জয়  (৬) কুবের  (৭) স্বামীদত্ত (৮) দমন (৯) মহেন্দ্রগিরি (১০) মহেন্দ্র (১১) ব্যাঘ্ররাজ এবং (১২) মন্তরাজ । এক্ষেত্রে তিনি বিজিত রাজ্যগুলিকে প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে না এনে পরাজিত রাজাদের বশ্যতা ও করপ্রদানের প্রতিশ্রুতি আদায় করে তা তাদের রাজ্যগুলি ফিরিয়ে দেন । এটি ‘গ্রহণ পরিমােক্ষ’ নীতি নামে পরিচিত ।

 iv) সীমান্তবর্তী রাজ্যজয় : সমুদ্রগুপ্ত সীমান্তবর্তী ৫ টি রাজ্য জয় করেন । বিজিত এই ৫ টি রাজ্য হল -
 
 (১) নেপাল 
 
(২) কতৃপুর ( পাঞ্জাবের জলন্ধর জেলা )

(৩) সমতট ( দক্ষিণ ও পূর্ব বঙ্গ ) 

(৪) দাভক ( আসামের নওগাঁ ) ও 

(৫) কামরূপ ( উত্তর আসাম ) 
 

v) অন্যান্য রাজ্যজয় : এ ছাড়া সমুদ্রগুপ্ত আরও ৯ টি প্রজাতির রাজ্যের বশ্যতা আদায় করেন । তার সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বের জন্য ঐতিহাসিক ড . ভিনসেন্ট স্মিথ তাকে ‘ভারতের নেপােলিয়ন’ বলে অভিহিত করেছেন । 

[        ] বহির্ভারতে প্রভাব : সমুদ্রগুপ্ত বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে মিত্ৰতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তােলেন । 

[i] পশ্চিম পাঞ্জাব ও আফগানিস্তানের কুষাণ বংশের রাজা দৈবপুত্র শাহী শাহানুশাহি পারসিক আক্রমণ  প্রতিরােধ করার জন্য সমুদ্রগুপ্তের সহায়তা চান । 

[ii] সিংহলের বার মেঘবর্ণ সমুদ্রগুপ্তের সভায় দূত পাঠান । 

[iii] জাভা , মালয় , সুমাত্রা, কম্বােডিয়া প্রভৃতি দেশের ওপর সমুদ্রগুপ্ত নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন । 

[iv] উত্তর পশ্চিম সীমান্তের কুষাণ ও শক শাসকরাও সমুদ্রগুপ্তের প্রাধান্য স্বীকার করে নেন । 

[         ] সুশাসন প্রতিষ্ঠা : কেবলমাত্র সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেই নয়, একজন সুশাসক হিসেবেও সমুদ্রগুপ্ত অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দেন 

[ i ] তিনি বৈদেশিক প্রভাবমুক্ত এক সম্পূর্ণ ভারতীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে তােলেন । শাসনকাজের সুবিধার জন্য সমুদ্রগুপ্ত তাঁর সাম্রাজাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেন । এই বিভাগগুলিকে বলা হতাে ‘দেশ‘ ও ‘ভুক্তি' । 

[ ii ] তিনি ভাগকর বা ভূমিকর , ভােগকর , চুঙ্গিকর , ভূতগ্রতায় বা আবগারি শুল্ক প্রভৃতি আদায় করতেন । ভাগ বা ভূমিকর ছিল উৎপন্ন ফসলের ১/৬ অংশ । সমুদ্রগুপ্ত তার শাসনব্যবস্থাকে জনকল্যাণের আদর্শের ওপর স্থাপন করেছিলেন । তাই ড , এইচ , সি ,রায়চৌধুরী বলেছেন , “ অশােক যেমন ধর্মপ্রচারের দ্বারা খ্যাতি অর্জন করেছেন । সমুদ্রগুপ্ত তেমনই সাম্রাজ্য স্থাপন ও সুশাসন প্রবর্তন করে স্মরণীয় হয়ে আছেন ।” 

[         ] বহুমুখী প্রতিভা : সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী । তিনি ছিলেন কবি ও গায়ক । সমকালীন মুদ্রায় তার বীণাবাদনরত প্রতিকৃতি থেকে তার সংগীতপ্রতিভার পরিচয় মেলে । তিনি কাব্য ও সাহিত্যচর্চার জন্য ‘কবিরাজ’ উপাধি লাভ করেন । হরিষেণ , অসঙ্গ , বসুন্ধু প্রমুখ পণ্ডিত তার রাজদরবারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । তাঁর , আমলে বিভিন্ন ধরনের স্থাপত্যশিল্পের বিকাশ ঘটে । 



[        ] ধর্মসহিষ্ণুতা : সমুদ্রগুপ্ত তাঁর সাম্রাজ্যে ধর্মসহিষ্ণুতার বাতাবরণ তৈরি করেন । তিনি নিজে ব্রাত্মণ্যধর্মের অনুরাগী হলেও অন্য ধর্মের প্রতি তার যথেষ্ট শ্রদ্ধা ছিল । তাই তিনি সিংহলরাজ মেঘবর্ণকে বুদ্ধগয়ায় বৌদ্ধমঠ নির্মাণের অনুমতি দেন এবং বসুবন্ধুর মতাে বৌদ্ধ পণ্ডিতকে উচ্চ রাজপদে বসান । 

উপসংহার : সমুদ্রগুপ্তের মতাে অসাধারণ রাজনৈতিক প্রতিভাসম্পন্ন , প্রশাসনিক ক্ষেত্রে দক্ষ, সামরিক কৃতিত্বে পারদর্শী এবং শিল্পও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষক রাজা প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে বিরল । ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে , ভারতের ইতিহাসে সমুদ্রগুপ্ত এক নতুন যুগের উদবােধন করেছিলেন । ইতিহাসবিদ জে . বি . গােখেল তাকে যথার্থই ‘প্রাচীন ভারতের সুবর্ণ যুগের অগ্রদূত’ বলে অভিহিত করেছেন ।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন