উত্তর : আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসা : বৈদিক যুগের শেষ দিকে মানুষের মনে আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধিপায় । ‘শ্রমণ’ ও ‘পরিব্রাজক’ নামে দুই সন্ন্যাসী গােষ্ঠীর প্রভাবে মানুষ কুসংস্কারপূর্ণ বৈদিক ধর্মের শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে ।
যাগযজ্ঞে জটিলতা বৃদ্ধি : বৈদিক যুগের শেষ দিকে ব্রাত্মণ্যধর্ম যাগযজ্ঞ ও আচারসর্বস্ব হয়ে পড়ায় ধর্মাচরণের পদ্ধতি সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে । উপরন্তু এই ব্যয়বহুল ধর্মাচরণ পদ্ধতির ব্যয় বহন করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে ।
ধর্মাচরণের অধিকার হ্রাস : পরবর্তী বৈদিক যুগে প্রচলিত ব্রাত্মণ্যধর্মে বৈশ্য ও শূদ্র শ্রেণির ধর্মাচরণের অধিকার বিশেষভাবে হ্রাস পায় । নারীরাও বেদ পাঠের অধিকার হারিয়ে ক্ষুদ্ধ হয় ।
কৃষকদের অবস্থার পরিবর্তন : খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে কৃষি উৎপাদন অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধি পায় । কিন্তু বৈদিক যাগযজ্ঞে প্রচুর পরিমাণ গাে-বলি শুরু হলে নতুন কৃষি অর্থনীতি সমস্যার সম্মুখীন হয় । এই সময় গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীর ‘জীবে দয়া’ এবং ‘অহিংসা’র বাণী প্রচার করলে কৃষকশ্রেণি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং আচার সর্বস্ব ব্রাত্মণ্য ধর্মব্যবস্থার পরিবর্তনে আগ্রহী হয়ে ওঠে ।
ব্যবসায়ী শ্রেণির উচ্চাকাকাঙ্খা : এই সময় নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বহু নতুন নগর প্রতিষ্ঠিত হয় । ফলে ব্যাবসা বাণিজ্য বৃদ্ধি পায় । বাণিজ্য বৃদ্ধির ফলে বৈশ্য শ্রেণির আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটে এবং তারা সামাজিক মর্যাদালাভের জন্য ব্রাত্মণ্যবাদের অবসান কামনা করে ।
ব্যয়বহুল আচার অনুষ্ঠান : বৈদিক ব্রাত্মণ্য ধর্ম ছিল আড়ম্বর সর্বস্ব এবং ব্যয়বহুল । ধর্মের প্রধান অঙ্গ ছিল যজ্ঞ। যত্ত পরিচালনার জন্য সাধারণ মানুষকে প্রচুর অর্থ ব্যয়করতে বাধ্য করা হত । তাই তারা নতুন ধর্মে আকৃষ্ট হয় ।
গণরাজ্য প্রতিষ্ঠা : খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতীয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু গণরাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয় । সেই গণরাজ্যগুলিতে মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতার সুযােগ এবং উপজাতীয় রীতিনীতির অনুসরণে বর্ণাশ্রমবিহীন সমাজের প্রতিষ্ঠা নব্য ধর্ম আন্দোলনের রাজনৈতিক পটভূমি তৈরি করেছিল ।
নতুন সমাজ স্থাপন : ব্রাত্মণ্যধর্মের রক্ষণশীলতার পরিবর্তে নবগঠিত গণরাজ্যগুলিতে উপজাতীয় রীতিনীতি অনুযায়ী বর্ণাশ্রম বিহীন নতুন সমাজ স্থাপিত হয় । সেখানে ব্রাত্মণদের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন বা বৈদিক রীতি মান্য করা বাধ্যতামূলক ছিল না ।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা : গণরাজ্যগুলিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ও স্বাধীন মতপ্রকাশের অবাধ সুযােগ ছিল । এই উদার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মহাবীর বা গৌতম বুদ্ধ ব্রাত্মণ্যবাদের অসাম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে সমাজসংস্কারের ডাক দিয়েছিলেন ।
ব্রাত্মণ সম্প্রদায়ের একাধিপত্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ : বর্ণবিভক্ত বৈদিক সমাজে ব্রাত্মণের স্থান ছিল সবার ওপরে — সমাজ ও রাষ্ট্রে তারা বহু সুযােগসুবিধার একচেটিয়া অধিকারী ছিল । অন্যান্য শ্রেণির মধ্যে ব্রাক্ষ্মণদের এই একচেটিয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছিল ।
ব্রাহ্রণ ক্ষত্রিয় দ্বন্দ্ব : যুদ্ধে অংশগ্রহণ , রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা ও প্রশাসন পরিচালনার মতাে গুরুদায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও সমাজ ও রাষ্ট্রে ব্রাত্মণদের তুলনায় ক্ষত্রিয়দের মর্যাদা ও অধিকার ছিল কম । এই পরিস্থিতি রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী ক্ষত্রিয়দের কাছে ক্রমেই অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায় এবং এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে নব্য ধর্ম আন্দোলনে ।
বৈশ্য ও শূদ্রদের ক্ষোভ : সম্পদ সৃষ্টি ও রাষ্ট্রে আর্থসামাজিক দায়দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও বৈদিক সমাজ বা রাষ্ট্র বৈশ্য ও শূদ্রদের কোনােরকম মর্যাদা দেয়নি । এই শ্রেণিবৈষম্য তাদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল । বৌদ্ধ ও জৈন , এই দুই নব্য ধর্মে বর্ণভেদহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার থাকায় , বৈশ্য ও শূদ্ররা এই দুই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল ।
ব্রাক্ষ্মণ্য সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নারীজাতির ক্ষোভ : ব্রাত্মণ সমাজে নারীজাতিকে সম্মানের চোখে দেখা হত না । বুদ্ধ ও মহবীর নারীজাতি , এমনকি সমাজচ্যুতা নারীদের মর্যাদা দেওয়ায় তারাও এই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয় ।
[ ] খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মানুষের মনে বুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ ঘটে । এর ফলস্বরূপ এই সময় জন্মান্তরবাদ, কর্মফল প্রভৃতি ধর্মাচরণকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে বলা হয় যে, সব মানুষকেই কর্মফল ভােগ করতে হবে ।
[ ] বৈদিক আর্যদের ভাষা সংস্কৃত হওয়ার জন্য তা সাধারণ মানুষের বােধগম্যের বাইরে ছিল । অন্যদিকে বুদ্ধদেব আঞ্চলিক পালি ভাষায় ধর্মপ্রচার করায় তা সর্বসাধারণের সহজবােধ্য হয় ।
মূল্যায়ণ : ধর্মকে মানুষের জীবনে সহজসরল রূপ দেওয়ার জন্য নব্য ধর্মের উত্থান ঘটে । নব্য ধর্মের মধ্য দিয়ে মানুষ এক মানবতাবাদী জীবনমুখী ধর্মের অনুসন্ধানে উগ্রীব হয়ে ওঠে । অধ্যাপক এ. এল . ব্যাসামের মতে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে , ‘বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক আলােড়নের মাধ্যমে ভারতের এক মহান ঐতিহাসিক যুগের সূচনা ঘটে ।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন