ইউরােপের ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের অবদান আলােচনা করাে ।
উত্তর : ইনডালজেন্সের বিরােধিতা : ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে যাজক টেটজেল সেন্ট পিটার্স চার্চ সংস্কারের অজুহাতে জার্মানির স্যাক্সনিতে যান । সেখানে তিনি পাপমুক্তির ছাড়পত্র হিসেবে ইনডালজেন্স বা মার্জনাপত্র বিক্রি করতে শুরু করেন । মার্টিন লুথার এই মার্জনাপত্র বিক্রয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান ।
লুথারের ৯৫ থিসিস : লুথার ইনডালজেন্স বা মার্জনাপত্র বিক্রয়ের বিরুদ্ধে উইটেনবার্গের বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় তার লিখিত প্রতিবাদপত্র ‘পঁচানব্বই থিসিস’ আটকে দেন । তার এই লিখিত প্রতিবাদের মধ্যে দিয়েই কলুষিত পােপতন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম জেহাদ ঘােষিত হয় ।
খ্রিস্টধর্যের আদর্শের পুনরুজ্জীবনে প্রচেষ্টা : মার্টিন লুথার খ্রিস্টধর্মাদর্শের পুনরুজ্জীবন ঘটান । লুথার বলেন যে ,ভগবান হলেন সর্বশক্তিমান এবং তার ইচ্ছাতেই পৃথিবীতে সবকিছু ঘটে চলেছে । লুথারের মতে , সমস্ত মানুষের ভাগ্যই পূর্বনির্ধারিত এবং যে কোনাে মানুষ মঙ্গলময় ঈশ্বরের করুণা বা ‘Gratia’ লাভের অধিকারী ।
অপ্রয়ােজনীয় আচার অনুষ্ঠানের বিরােধিতা : লুথার ক্যাথলিকধর্মের অধিকাংশ আচার অনুষ্ঠানকেই অপ্রয়ােজনীয় বলে মনে করতেন । খ্রিস্টের শেষ নৈশভােজের স্মরণে খাদ্যরূপে রুটি ও মদ গ্রহণ রীতি , খ্রিস্টধর্মের আনুষ্ঠানিক দীক্ষাগ্রহণ , দোষী ব্যক্তিকে পাদরি কর্তৃক শাস্তি প্রদান এবং অর্থের বিনিময়ে পাপমুক্তি ক্রয় প্রভৃতি অপ্রয়োজনীয় আচার অনুষ্ঠানের বিরােধিতা করেন লুথার ।
প্রতিবাদী খ্রিস্টধর্মের প্রতিষ্ঠা : লুথারের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলে খ্রিস্টানগণ দুটি সম্প্রদায়ে ভাগ হয়ে যান । পােপতন্ত্রের অনুগামী বা সমর্থকগণ ক্যাথলিক এবং পােপ বিরুদ্ধকারী তথা লুথারের সমর্থনকারীগণ প্রােটেস্ট্যান্ট বা প্রতিবাদী নামে পরিচিতি পান ।
রাষ্ট্রশক্তির সুদৃঢ়করণ : লুথার বলেন যে, সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অন্যায়ের প্রতিকার করার দায়িত্ব শাসকের । তাই পােপ বা যাজক নয় , শাসক ও তাঁর কর্মচারীরাই হলেন পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি । লুথারের এই মত ইউরােপে রাজতন্ত্র ও জাতীয় রাষ্ট্রগুলিকে শক্তিশালী করে ।
পােপের কাছে প্রতিবাদ : খ্রিস্টধর্মের এবং চার্চের বিভিন্ন অনাচারের বিরুদ্ধে লুথার বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু প্রতিবাদী বক্তৃতা করেন এবং রােমে গিয়ে পােপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন । যাবতীয় ধর্মীয় অনাচার ও দুর্নীতি দূর করার জন্য তিনি পােপকে অনুরােধ জানান । কিন্তু পােপ তাঁর আবেদনে সাড়া দেননি ।
বাইবেলের অনুবাদে উৎসাহদান : লুথারবাদীরা মনে করতেন যে ,জ্ঞান ও বিশ্বাস অর্জনের জন্য শাস্ত্র পড়া প্রয়ােজন । এই লক্ষেই নিজ নিজ ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ প্রয়ােজন । লুথার এই বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত হয়ে বাইবেলের অনুবাদে উৎসাহ জোগান ।
লিখিত প্রতিবাদ : লুথার অজস্র গ্রন্থ ও পুস্তিকা রচনার মধ্য দিয়ে চার্চতন্ত্রের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হন । তিনি তার ‘বন্ডেজ অব দ্য উইল’ প্রবন্ধে লেখেন , ‘মানুষ ঈশ্বরের ইচ্ছার দাস ,শুধু কাজের দ্বারা সে তার নিজের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে না ।’ ‘বাবিলনিয়ান ক্যাপটিভিটি’ গ্রন্থে লুথার বলেন যে, জার্মান জাতির চার্চ পোপতন্ত্রের অধীনতা থেকে মুক্ত হতে চায় । ‘রেজোলিউশান’ গ্রন্থে লুথার পােপের ক্ষমতাকে অস্বীকার করেন ।
ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রসার : মার্টিন লুথার সর্বপ্রথম জার্মানিতে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূচনা ঘটান । পরবর্তীকালে এই ধর্মসংস্কার আন্দোলনের রেশ ছড়িয়ে পড়ে মধ্য,পূর্ব এবং পশ্চিমা ইউরােপের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ।
মূল্যায়ন : একজন দুঃসাহসী ধর্মসংস্কারক হিসেবে মার্টিন লুথার চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন । তিনিই প্রথম ষোড়শ শতকে পােপতন্ত্র এবং চার্চতন্ত্রের যাবতীয় অনাচার এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হন । গেরহার্ড তাই বলেছেন যে, “এই ধর্মবিপ্লবের সাফল্যের জন্য লুথারের প্রচারশক্তি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ।”
কোন মন্তব্য নেই