ন্যায়মতে ব্যাপ্তি কাকে বলে ? ব্যাপ্তি জ্ঞানের উপায়গুলি কী কি ?
উত্তর : ব্যাপ্তি শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল ব্যাপকতা বা বিস্তৃতি । এই ব্যাপকতা বা বিস্তৃতি হল পদের ব্যাপকতা । একটি পদ ব্যাপক হতে পারে , আবার তা ব্যাপ্যও হতে পারে । যার দ্বারা ব্যাপ্ত হয় , তাকেই বলা হয় ব্যাপক , আর যা ব্যাপ্ত হয় তাকেই বলা হয় ব্যাপ্য । ব্যাপ্তি হল এই ব্যাপ্য ও ব্যাপকের মধ্যে একপ্রকার সম্বন্ধ । অনুমানের ক্ষেত্রে হেতু তথা ধোঁয়াকে বলা হয় ব্যাপ্য আর সাধ্য তথা আগুনকে বলা হয় ব্যাপক ।
[ ] সহচর নিয়মরূপে ব্যাপ্তি : ন্যায়দর্শনে ব্যাপ্তিকে ব্যাপ্য ও ব্যাপকের মধ্যে সহচর নিয়মরূপে উল্লেখ করা হয়েছে । ব্যাপ্তির প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাধ্য ও হেতুর সহচর দর্শন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । দুটি বিষয় যদি সহগামী হয় , তবে তাদের সম্বন্ধকে বলা হয় সহচর সম্বন্ধ । হেতু ও সাধ্য সহগামী বলেই এদেরকে সহচররূপে উল্লেখ করা হয়েছে । এই দুটি সহচারের অন্তঃস্থিত সম্বন্ধকেই বলা হয় সহচর নিয়ম । এরূপ সহচর নিয়মই হল ব্যাপ্তি । সুতরাং , ‘যেখানে যেখানে ধোঁয়া আছে , সেখানে সেখানে আগুন আছে ’ — এরূপ হেতু ও সাধ্যের সহচার নিয়মকেই বলা হয় ব্যাপ্তি সম্বন্ধ ।
[ ] ব্যাপ্তিগ্রহের উপায় কী ? অর্থাৎ, কীভাবে ব্যাপ্তি সম্বন্ধের জ্ঞান প্রতিষ্ঠা করা যায় ? এরূপ প্রশ্নের উত্তরে নৈয়ায়িকগণ নীচের পদ্ধতিগুলির উল্লেখ করেছেন
[ ] অম্বয় : ‘অন্বয়’ শব্দটির অর্থ হল মিল বা সাদৃশ্য । দুটি বিষয়ের একসঙ্গে উপস্থিতিই হল অন্বয় । ধোঁয়া এবং আগুন — এ দুটিই যদি একসঙ্গে উপস্থিত হয় ,তাহলে দাবি করা যায় যে ,ধোঁয়া এবং আগুনের মধ্যে অন্বয় বা মিল আছে । এরই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে —যেখানে যেখানে ধোঁয়া আছে , সেখানে সেখানে আগুন আছে । আর এরূপ অন্বয়মূলক সম্বন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ করা যায় যে , ধোঁয়া ও আগুনের (হেতু ও সাধ্যের ) মধ্যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ আছে ।
[ ] ব্যতিরেক : ব্যাপ্তি জ্ঞানের উপায় হিসেবে ব্যতিরেকের কথা নৈয়ায়িকেরা বলেছেন । ব্যতিরেক শব্দটির অর্থ হল দুই বিষয়ের একত্র অনুপস্থিতি । অর্থাৎ , একটি না থাকলে ,অন্যটিও থাকে না । এই ব্যতিরেক নিয়মের সাহায্যেই আমরা বলতে পারি যে, যেখানে যেখানে ধোঁয়া নেই , সেখানে সেখানে আগুনও নেই । এরূপ ব্যতিরেক সহচর সম্বন্ধের পরিপ্রেক্ষিতেই দাবি করা যায় যে ,ধোঁয়া এবং আগুনের ( হেতু ও সাধ্যের ) মধ্যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে ।
[ ] ব্যভিচারাগ্রহ : ব্যভিচার শব্দটির অর্থ হল নিয়মবিরুদ্ধ বিপরীত দৃষ্টান্ত । আর আগ্রহ শব্দটির অর্থ হল অদর্শন । অর্থাৎ ,যে দুটি ঘটনার মধ্যে ব্যাপ্তি তথা সহচর সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠা করা হয় , তাদের মধ্যে এমন কোনাে নিয়মবিরুদ্ধ বিপরীত দৃষ্টান্ত দেখা যাবে না —যেখানে একটি আছে , অথচ অন্যটি নেই । ধোঁয়া আছে অথচ আগুন নেই এমনটি তাই হতে পারে না । ব্যাপ্তি জ্ঞানের এরূপ শর্তটিকেই বলা হয় ব্যভিচারাহ (ব্যভিচার + অগ্রহ ) ।
[ ] উপাধি নিরাস : ব্যাপ্তি সম্বন্ধের ক্ষেত্রে কোনাে উপাধি তথা শর্ত থাকে না । উপাধি শব্দের অর্থ হল শর্ত এবং নিরাস শব্দের অর্থ হল হীন বা নাই । দুটি বিষয়ের মধ্যে যে কোনাে প্রকার শর্ত নেই , এমন নিশ্চিত হলে তবেই ওই দুটি বিষয়ের মধ্যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ আছে বলে মানা যাবে । দুটি বিষয়ের মধ্যে যে নাই ( উপাধি নিরাস ) তা, জানা যায় বারংবার একই বিষয়ের দর্শন অর্থাৎ ভূয়ােদর্শনের মাধ্যমে । দুটি বিষয় শর্তহীন হলে তবেই তাদের মধ্যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ।
[ ] তর্ক : ব্যাপ্তি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার আরও একটি উপায় বা শর্ত হিসেবে নৈয়ায়িকগণ তর্ক - কে উল্লেখ করেছেন । ধোঁয়া ও আগুনের মধ্যে যে ব্যাপ্তি সম্পর্ক আছে , বর্তমানকালে প্রত্যক্ষ করা সম্ভব হলেও অতীত বা ভবিষ্যৎকালেও যে সম্ভব হবে , সেই বিষয়ে সংশয় থাকতেই পারে । এই সংশয় নিরসনের জন্যই নৈয়ায়িকগণ তর্কের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন । এই তর্ক হল এক প্রকারের আনুমানিক পরােক্ষ পদ্ধতি । এর সাহায্যে মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের বিরুদ্ধ বচনকে অসত্যরূপে প্রমাণ ক'রে পরােক্ষে ওই মূল বাক্যের সত্যতাকেই প্রমাণ করা হয় । এরূপ পদ্ধতির দ্বারা হেতু ও সাধ্যের মধ্যে ব্যাপ্তি জ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হতে পারে ।
[ ] সামান্য লক্ষণ প্রত্যক্ষ : ব্যাপ্তি জ্ঞানকে সমস্ত রকম সংশয় থেকে মুক্ত করার প্রয়াসে নৈয়ায়িকগণ সামান্য লক্ষণ প্রত্যক্ষের উল্লেখ করেছেন । এটাই হল ব্যাপ্তি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সর্বশেষ স্তর । পূর্বের পাঁচটি পদ্ধতি অবলম্বন করে হেতু ও সাধ্যের মধ্যে যে ব্যাপ্তি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়, তাকে নৈয়ায়িকগণ সামান্য লক্ষণ প্রত্যক্ষের মাধ্যমে আরও নিশ্চিত করেছেন ।
কোন মন্তব্য নেই