সোমবার, ১ আগস্ট, ২০২২

কর্মযােগের আদর্শ কী ? আলোচনা করো ।

একাদশ শ্রেণী দর্শন প্রশ্নোত্তর xi class 11 philosophy Question answer কর্মযােগের আদর্শ কী আলোচনা করো kormoyoger adorsho ki alochona koro


উত্তর : স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তার কর্মযােগ গ্রন্থে কর্ম সম্বন্ধে বিশদে আলােচনা করেছেন । তিনি কর্মযোগের মাধ্যমেই আমাদের মুক্তিলাভের কথা বলেছেন ।
[ 1 ] মুক্তিই জীবনের চরম লক্ষ্য : বেদান্ত ধর্মের মহানভাব এই যে , আমরা বিভিন্ন পথে সেই একই চরম লক্ষ্যে উপনীত হই । এই পথগুলি হল— কর্ম , ভক্তি,যােগ ও জ্ঞানের পথ । কিন্তু এ কথা অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে , এই সমস্ত পথ কখনােই বাঁধাধরা কিছু নয় এবং অত্যন্ত পৃথকও নয় । একটি অন্যগুলির সঙ্গে অত্যন্ত সহজেই মিশে যেতে পারে ।এমন কোনাে লোকই দেখা যায় না, যার কর্ম করার শক্তি ব্যতীত আর অন্য কিছু নেই । এমন কোনাে ভক্ত নেই, যার ভক্তি ছাড়া আর কিছুই নেই । আবার এমন কোনাে ব্যক্তি নেই , যার জ্ঞান ছাড়া আর কিছুই নেই । এই ধরনের বিভাগ কেবলমাত্র মানুষের গুণ বা প্রবণতার প্রাধান্য অনুযায়ীই করা হয় । কিন্তু শেষপর্যন্ত এই চারটি পথ একই ভাবের অভিমুখে মিলিত হয় । এই চরম ভবিটি হল মানুষের মােক্ষ বা মুক্তি । 

[ 2 ] কর্মযােগ মােক্ষলাভের এক নীতি ও প্রণালী : প্রত্যেকটি ধর্মেই মুক্তির জন্য প্রাণপণ চেষ্টার বিষয়টি আমরা লক্ষ করি । এ হল সমুদয় নীতি ও নিঃস্বার্থপরতার ভিত্তি । নিঃস্বার্থপরতার অর্থ হল আমি কেবলই আমার এই শরীর — এই ভাব থেকে মুক্ত হওয়া । মানুষ তখন অনন্তস্বরূপ হয়ে যায় । এই অনন্ত বিস্তৃতিই হল সকল ধর্মের, সকল নীতি শিক্ষার এবং দর্শনের মূল লক্ষ্য । নিঃস্বার্থ কর্ম দ্বারা মুক্তি লাভ করাই হল কর্মযােগ । সুতরাং প্রত্যেক স্বার্থপূর্ণ কার্যই আমাদের সেই লক্ষ্যে পৌঁছােনাের পথে বাধাস্বরূপ । আর নিঃস্বার্থভাবে কর্মই আমাদেরকে সেই লক্ষ্যে টেনে নিয়ে যায় । সেকারণেই স্বামী বিবেকানন্দ নৈতিকতার সংজ্ঞায় বলেছেন , যা স্বার্থশূন্য তাই নীতিসংগত , আর যা স্বার্থযুক্ত তাই নীতিবিরুদ্ধ । সুতরাং , কর্মযােগ হল নিঃস্বার্থপরতা ও সৎকর্ম দ্বারা মুক্তি লাভ করার এক নীতি ও প্রণালী । 

[ 3 ] কর্মযােগের একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে নিরন্তরভাবে নিষ্কাম কম : কর্মযােগীর কোনাে নির্দিষ্ট ধর্মমতে বিশ্বাস করার আবশ্যকতা নেই । তিনি ঈশ্বর বিশ্বাসী হন বা না-হন ,তাতে কিছুই যায় আসে না । তাকে কোনাে মতবাদের সাহায্য না নিয়েও , কেবলমাত্র কর্ম দ্বারা সমস্যার সমাধান করতে হয় । স্বামী বিবেকানন্দ তাই তার কর্মযােগে বলেছেন যে , জগৎযন্ত্রের চক্র থেকে পালিয়ে না গিয়ে , এর ভিতরে থেকেই কর্মের রহস্য সম্বন্ধে শিক্ষা নিতে হবে । জগৎযন্ত্ররূপ চক্রের মধ্য দিয়েই আমাদের মুক্তির দিকে এগিয়ে যেতে হবে । এক্ষেত্রে তাই একমাত্র উপায় হল অনাসক্ত হয়ে , সমুদয় কর্মের ফল ত্যাগ করে ,নিষ্কামভাবে নিরন্তর কর্ম করা । আর এখানেই কর্মযােগের আদর্শটি নিহিত । 


[ 4 ] প্রকৃত কর্মযােগীরূপে বুদ্ধদেব : বিবেকানন্দ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন বুদ্ধদেবের কথা , যিনি কর্মযােগের আদর্শকে কার্যে পরিণত করেছেন । বিবেকানন্দ বলেন যে , বুদ্ধ ব্যতীত জগতের অন্যান্য মহাপুরুষগণ বাহ্য প্রেরণার বশেই নিঃস্বার্থ কর্মে প্রবৃত্ত হয়েছেন । বহির্জগৎ থেকেই তারা পুরস্কার আশা করেছেন । কিন্তু একমাত্র বুদ্ধদেবই অন্তরের প্রেরণা থেকে নিঃস্বার্থভাবে কর্ম করেছেন । তিনি ঈশ্বর বা আত্মতত্ত্বে মাথা ঘামাননি , তিনি শুধুমাত্র সকলকে সৎকর্ম করার পরামর্শ দিয়েছেন । তিনি আরও বলেছেন যে , মানুষের সৎকর্মই মানুষকে মুক্তি দেবে । বুদ্ধদেব একজন দার্শনিক হয়েও , তুচ্ছতম ও নিম্নতম প্রাণীর জন্যও সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন । নিজের জন্য তিনি কিছুই দাবি করেননি । প্রকৃতপক্ষে তিনিই হলেন আদর্শ কর্মযােগী । বিবেকানন্দ তাই বলেন যে, অভিসন্ধি ছাড়া যিনি কর্ম করেন , তিনি একজন বুদ্ধদেবে পরিণত হন এবং কর্মযােগের প্রকৃত আদর্শকে বহন করেন । এরূপ ব্যক্তিই হলেন কর্মযােগের চরম আদর্শের দৃষ্টান্ত ।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন