সকাম ও নিষ্কাম কর্মের মধ্যে পার্থক্য কী ? বিবেকানন্দ কীভাবে নিষ্কাম কর্মকে ব্যাখ্যা করেছেন ?
উত্তর : ভারতীয় দর্শনে দুপ্রকার কর্মকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে — সকাম ধর্ম ও নিষ্কাম ধর্ম । সকাম কর্ম হল কামনা বাসনা যুক্ত কর্ম । অর্থাৎ , বলা যায় যে , যে সমস্ত কর্ম আমাদের কামনা বাসনাকে চরিতার্থ করার জন্য করা হয়, সেগুলিকেই বলা হয় সকাম কৰ্ম । এই সকাম কর্মের জন্যই আমাদের কর্মফল ভোগ করতে হয় । অপরদিকে , নিষ্কাম কর্ম হল এমনই কর্ম যা কামনা বাসনা চরিতার্থ করার জন্য কখনোই কৃত নয় । কামনা বাসনা ছাড়া শুধুমাত্র কর্ম করার জন্যই যে কর্ম করা হয় তাকে বলে নিষ্কাম কর্ম । নিঃ(নাই) + কাম ( কামনা ) = নিষ্কাম । অর্থাৎ, যে কর্মের পিছনে কোনাে কামনা থাকে না তাকে বলে নিষ্কাম কর্ম । এরূপ কর্মের কোনাে কর্মফল থাকে না এবং সে কারণেই মানুষকে এর জন্য কোনাে কর্মফল ভোগ করতে হয় না ।নিষ্কাম কর্ম এক আদর্শমূলক কর্ম যা গীতায় স্বীকৃত হয়েছে এবং বিবেকানন্দ তার কর্মযােগের মূল ভিত্তি রূপে উল্লেখ করেছেন এই নিষ্কাম কর্মকে ।
[ ] বিবেকানন্দের মতে নিষ্কাম কার্য : স্বামী বিবেকানন্দ তার কর্মযােগ এ কর্মের আদর্শগত ব্যাখ্যা দিতে দিয়ে শ্রীমদভাগবত গীতায় যে নিষ্কাম কর্মের কথা বলা হয়েছে , তার উল্লেখ করেছেন । তিনি বলেন যে ,প্রকৃত কর্মযােগীকে নিষ্কামভাবে কর্ম সম্পাদন করতে হয় । কারণ , যিনি কর্মযােগী রূপে গণ্য, তিনি কখনােই ফলাকাঙ্ক্ষা নিয়ে কর্ম সম্পাদন করেন না । তিনি শুধুমাত্র কর্মের জন্যই কর্ম সম্পাদন করেন । কর্মযোগীর কর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে তাই কখনোই কামনা বাসনা থাকা উচিত নয় । কর্মযােগীর শুধুমাত্র নিরন্তর নিষ্কামভাবে কর্ম করে যাওয়াই উচিত , আর কর্মফল ঈশ্বরে সমর্পন করা উচিত । ঈশ্বরই হলেন আমাদের সমস্ত প্রকার কর্মের নিয়ন্ত্রা । এরূপ বিশ্বাসই কর্মযােগীর থাকা উচিত । গীতায় উল্লেখিত কর্মের এরুপ আদর্শকেই স্বামী বিবেকানন্দ তার কর্মযােগের মূল ভিত্তিরূপে উল্লেখ করেছেন ।
[ ] অনাসক্তির শক্তিতে নিষ্কাম কর্ম : কর্মযােগের ষষ্ঠ অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে , অনাসক্তিই হল পরিপূর্ণ আত্মত্যাগ । বাহ্যবিষয়ে অনাসক্তি অর্জন করতে হলে নিরন্তরভাবে নিষ্কাম কর্ম করতে হবে । নিষ্কামভাবে কর্ম করার ক্ষমতা মানুষ কখনােই একদিনে আয়ও করতে পারে না । ক্রমিক ও নিরন্তর কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে মানুষ ধীরে ধীরে এরূপ শক্তি অর্জন করতে পারে । মানুষ ক্রমে ক্রমে বুঝতে সমর্থ হয় যে , প্রকৃত সুখ হল স্বার্থপরতার বিনাশে । সে কারণেই মানুষের সকাম ও স্বার্থ যুক্ত কর্ম করা কখনােই উচিত নয় । অনাসক্তিকে আয়ত্ত করে ,দুর্বলতাকে পরিহার করে , মানসিক বলে বলীয়ান হয়ে তবেই কর্মযােগী নিষ্কামভবে কর্ম করতে সমর্থ হয় ।
[ ] মুক্তিতে নিষ্কাম কর্ম : স্বামীবিবেকানন্দ তার কর্মযােগ - এর সপ্তম অধ্যায়ে মুক্তির বিষয়টি আলােচনা করেছেন । বিবেকানন্দের মতে ,মানুষের চরম লক্ষ্য হল মুক্তি । মুক্তি লাভের জন্য মানুষ এই সসীমত্বের বাঁধন কেটে সবকিছুর উর্ধ্বে উঠতে চায় । মুক্তির জন্য মানুষ সমস্তপ্রকার আসক্তিকে ত্যাগ করতে চায় । এই আসক্তি ত্যাগের উপায় হল দুটি নিবৃত্তি মার্গ এবং প্রবৃত্তি মার্গ । নিবৃত্তি মার্গে নেতি নেতি (এটি নয় এটি নয় ) করে সব কিছু ত্যাগ করতে হয় । আর প্রবৃত্তি মার্গে ইতি ইতি করে সবকিছুকে গ্রহণ করে তবে সেগুলিকে ত্যাগ করতে হয় । সাধারণ মানুষ প্রবৃত্তি মার্গকে মুক্তির পথ হিসেবে বেছে নিলেও মহাপুরুষগণ কিন্তু নিবৃত্তি মার্গকেই মুক্তির পথ বলে মনে করেন । যে পথই অনুসরণ করা হােক না কেন , একথা ঠিক যে , মুক্তি পেতে গেলে মানুষকে অবশ্যই নিষ্কামভাবে কর্মযােগের আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে হবে । এরূপ বিষয়টিই বিবেকানন্দ তার কর্মযােগে তুলে ধরেছেন ।
কোন মন্তব্য নেই