জিয়াউদ্দিন বারনি বর্ণিত সুলতানি যুগের নরপতিত্বের আদর্শ কী ছিল ? দিল্লি সুলতানি শাসন কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল ?
উত্তর : নরপতিত্বের আদর্শ সম্পর্কে যেসব বিষয় তিনি তুলে ধরেছেন , সেগুলি হলো –
(১) ইসলামীয় কর্তব্য পালন : বারনি সুলতানকে তার শাসনকাজে ইসলামকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন । তিনি রাষ্ট্রশক্তির প্রয়ােগ ঘটিয়ে ইসলামের আদর্শ ও ভাবধারা ফিরিয়ে আনার পক্ষপাতী ছিলেন । ইসলামের আদর্শ সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য সুলতানের হাতে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব থাকা উচিত বলে তিনি উল্লেখ করেছেন ।
(২) বংশকৌলিন্য : বারনি তাঁর ‘ফতােয়া -ই-জাহান্দারি’ গ্রন্থে সর্বোচ্চ ক্ষমতার ব্যবহারকারী হিসেবে সম্রাটের বংশকৌলীন্যের ওপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন । তাঁর মতে , সম্রাট বা সুলতান যদি উচ্চ ও পরাক্রমশালী রাজবংশের হন , তবে সাধারণ প্রজাদের মনে তার সম্পর্কে উচ্চ ধারণা তৈরি হবে এবং স্বাভাবিকভাবেই তিনি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য লাভ করবেন ।
(৩) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা : বারনি বলেছেন , শাসকের প্রধান কর্তব্য হল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা । এর মাধ্যমে শাসক বা সুলতান ঈশ্বরের রাজ্যে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি প্রজাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করবেন । ন্যায়বিচার বলতে বারনি সত্য , ন্যায় ও ধর্মের প্রতিষ্ঠাকে বুঝিয়েছেন ।
(৪) শরিয়তের বিধান অনুসরণ : বারনির মতে , একজন শাসক শরিয়ৎ মেনে সফলভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন । এ প্রসঙ্গে তিনি সুলতানি রাজতন্ত্রকে পারস্যের সাসানীয় রাজতন্ত্রকে অনুকরণ করার কথা বলেছেন । অবশ্য শরিয়তের বিধান ও ভারতবর্ষের বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য থাকায় বারনি ‘জাওয়াবিত’ নামে রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়নের কথা বলেছেন ।
(৫) মন্ত্রণা সভার সিদ্ধান্ত গ্রহণ : বারনি বলেছেন যে , রাজাকে অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ পারিষদদের নিয়ে একটি মন্ত্রণা সভা গঠন করতে হবে । রাজা কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে সেই সভার পরামর্শদাতাদের সঙ্গে আলােচনা করবেন । রাজা যেমন কোনাে বিষয় তাদের কাছে গােপন করবেন না, তেমন তাদের মতামতও বাইরে প্রকাশ করবেন না ।
[ ] দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি কীরুপ ছিল তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে । ড .এ .এল . শ্রীবাস্তব, ড . ঈশ্বরী প্রসাদ, ড .রামশরণ শর্মা প্রমুখ মনে করেন যে , দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ছিল ‘ধর্মাশ্রয়ী’ । অন্যদিকে , সুলতানি যুগের ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারনি দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রকে ‘জাহান্দারি’ বা ‘ধর্মনিরপেক্ষ ’বলে অভিহিত করেছেন । ড . সতীশ চন্দ্র, ড. মহম্মদ হাবিব প্রমুখ আধুনিক ঐতিহাসিক এই অভিমত সমর্থন করেন ।
[ ] ‘ধর্মাশ্রয়ী’ বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তি :
i) খলিফার প্রতি আনুগত্য : আলাউদ্দিন খলজি ছাড়া দিল্লির সব সুলতানই ইসলামি জগতের শাসক ও ধর্মগুরু খলিফার স্বীকৃতি গ্রহণ করেন এবং তার প্রতি আনুগত্য জানিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন ।
ii) উলেমা ও শরিয়তের গুরত্ব : সুলতানি শাসনে উলেমাদের উল্লেখযােগ্য ভূমিকা ছিল । ইসলামি আইন ‘শরিয়ত’ এর ব্যাখ্যাকর্তা এই উলেমারা আশা করতেন যে , সুলতান অমুসলিমদের বিনাশসাধনে উদ্যোগ নেবেন এবং শরিয়তের বিধান মেনে ভারতবর্ষকে দার - উল - ইসলাম অর্থাৎ ইসলামের পবিত্র ভূমিতে পরিণত করবেন ।
iii) হিন্দুদের উপেক্ষা : সুলতানি রাষ্ট্রে অমুসলিম হিন্দুরা উপেক্ষিত ও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়েছিল । তারা ‘জিম্মি’ হিসেবে গণ্য হত এবং তাদের কাছ থেকে ‘জিজিয়া’ কর আদায় করা হত ।
[ ] ‘ ধর্মনিরপেক্ষ ’ বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তি :
i) পৃথক রাজতন্ত্র : শরিয়তের বিধান অনুসারে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলেন স্বয়ং ঈশ্বর । তার প্রতিনিধি হলেন প্রথমে হজরত মহম্মদ এবং পরে খলিফা । কিন্তু ভারতের সুলতানি রাষ্ট্রে এই নিয়ম থেকে স্বতন্ত্র রাজতন্ত্র গড়ে উঠেছিল ।
ii) খলিফার প্রতি আপাত আনুগত্য : কোনাে কোনাে সুলতান রাজনৈতিক প্রয়ােজনে খলিফার অনুমতি নিয়েছেন ঠিকই , কিন্তু সেটা ছিল একান্তই সুলতানের ইচ্ছাধীন বিষয় ।
iii) সুলতানের স্বাধীনতা : ইসলামি আইন অনুসারে খলিফা সমগ্র মুসলিম ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রধান হলেও ভারতে এই রীতি গুরুত্ব পায়নি । এখানে সুলতানগণ খলিফার নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে শাসন চালাতে পারতেন ।
iv) হিন্দুদের গুরত্ব : সুলতানি আমলে হিন্দুদের গুরুত্ব একেবারে লুপ্ত হয়ে যায়নি । তখন বহু হিন্দু উচ্চ রাজকার্যে নিযুক্ত হতেন এবং দেশের নানা স্থানে বহু হিন্দু সামন্ত রাজ্যের অস্তিত্বও ছিল ।
v) উলেমাদের সুলতান নির্ভরতা : সুলতানি আমলে উলেমারা সুলতানদের প্রভাবিত করতে পারতেন না , বরং বাস্তবে উলেমারা সুলতানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে কাজ করতেন ।
vi) শরিয়ত বহির্ভূত নির্দেশ : সুলতানি আমলে শরিয়তের নির্দেশ লঙ্ঘন করে বহু কাজ সম্পন্ন হওয়ার উদাহরণও দেখা যায় ।
vii) ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র : উপরােক্ত বিভিন্ন যুক্তির নিরিখে অধিকাংশ পণ্ডিত সুলতানি রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলেই অভিহিত করেন ।
উপসংহার : তাই রাষ্ট্ররূপে দিল্লি সুলতানির প্রকৃতি নির্বাচন করা কিছুটা কঠিন , কারণ ধর্মাশ্রয়ী এবং ধর্মনিরপেক্ষ এই দুই ধরনের রাজতান্ত্রিক প্রবৃত্তিই দেখা গেছে এর মধ্যে । রাজনৈতিক মাপগণ্ডির বিচারেও কেউ কেউ দিল্লি সুলতানিকে কেন্দ্রীভূত এবং কেউ বা আবার বিকেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করেছেন ।
কোন মন্তব্য নেই