বৃহস্পতিবার, ৭ জুলাই, ২০২২

জিয়াউদ্দিন বারনি বর্ণিত সুলতানি যুগের নরপতিত্বের আদর্শ কী ছিল ? দিল্লি সুলতানি শাসন কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল ?

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer জিয়াউদ্দিন বারনি বর্ণিত সুলতানি যুগের নরপতিত্বের আদর্শ কী ছিল দিল্লি সুলতানি শাসন কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল jiyauddin baroni bornito sultani juger noropotitter adorsho ki chilo delhi sultani shashon ki dhormashroyi chilo

উত্তর : নরপতিত্বের আদর্শ সম্পর্কে যেসব বিষয় তিনি তুলে ধরেছেন , সেগুলি হলো – 
 

(১) ইসলামীয় কর্তব্য পালন : বারনি সুলতানকে তার শাসনকাজে ইসলামকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন । তিনি রাষ্ট্রশক্তির প্রয়ােগ ঘটিয়ে ইসলামের আদর্শ ও ভাবধারা ফিরিয়ে আনার পক্ষপাতী ছিলেন । ইসলামের আদর্শ সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য সুলতানের হাতে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব থাকা উচিত বলে তিনি উল্লেখ করেছেন । 


(২) বংশকৌলিন্য : বারনি তাঁর ‘ফতােয়া  -ই-জাহান্দারি’ গ্রন্থে সর্বোচ্চ ক্ষমতার ব্যবহারকারী হিসেবে সম্রাটের বংশকৌলীন্যের ওপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন । তাঁর মতে , সম্রাট বা সুলতান যদি উচ্চ ও পরাক্রমশালী রাজবংশের হন , তবে সাধারণ প্রজাদের মনে তার সম্পর্কে উচ্চ ধারণা তৈরি হবে এবং স্বাভাবিকভাবেই তিনি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য লাভ করবেন । 

(৩) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা : বারনি বলেছেন , শাসকের প্রধান কর্তব্য হল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা । এর মাধ্যমে শাসক বা সুলতান ঈশ্বরের রাজ্যে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি প্রজাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করবেন । ন্যায়বিচার বলতে বারনি সত্য , ন্যায় ও ধর্মের প্রতিষ্ঠাকে বুঝিয়েছেন ।  


(৪) শরিয়তের বিধান অনুসরণ : বারনির মতে , একজন শাসক শরিয়ৎ মেনে সফলভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন । এ প্রসঙ্গে তিনি সুলতানি রাজতন্ত্রকে পারস্যের সাসানীয় রাজতন্ত্রকে অনুকরণ করার কথা বলেছেন । অবশ্য শরিয়তের বিধান ও ভারতবর্ষের বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য থাকায় বারনি ‘জাওয়াবিত’ নামে রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়নের কথা বলেছেন । 

(৫) মন্ত্রণা সভার সিদ্ধান্ত গ্রহণ : বারনি বলেছেন যে , রাজাকে অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ পারিষদদের নিয়ে একটি মন্ত্রণা সভা গঠন করতে হবে । রাজা কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে সেই সভার পরামর্শদাতাদের সঙ্গে আলােচনা করবেন । রাজা যেমন কোনাে বিষয় তাদের কাছে গােপন করবেন না, তেমন তাদের মতামতও বাইরে প্রকাশ করবেন না ।

[         ] দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি কীরুপ ছিল তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে । ড .এ .এল . শ্রীবাস্তব, ড . ঈশ্বরী প্রসাদ, ড .রামশরণ শর্মা প্রমুখ মনে করেন যে , দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ছিল ‘ধর্মাশ্রয়ী’ । অন্যদিকে , সুলতানি যুগের ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারনি দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রকে ‘জাহান্দারি’ বা ‘ধর্মনিরপেক্ষ ’বলে অভিহিত করেছেন । ড . সতীশ চন্দ্র, ড. মহম্মদ হাবিব প্রমুখ আধুনিক ঐতিহাসিক এই অভিমত সমর্থন করেন ।  


[       ] ‘ধর্মাশ্রয়ী’ বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তি : 

i) খলিফার প্রতি আনুগত্য : আলাউদ্দিন খলজি ছাড়া দিল্লির সব সুলতানই ইসলামি জগতের শাসক ও ধর্মগুরু খলিফার স্বীকৃতি গ্রহণ করেন এবং তার প্রতি আনুগত্য জানিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন । 

ii) উলেমা ও শরিয়তের গুরত্ব : সুলতানি শাসনে উলেমাদের উল্লেখযােগ্য ভূমিকা ছিল । ইসলামি আইন ‘শরিয়ত’ এর ব্যাখ্যাকর্তা এই উলেমারা আশা করতেন যে , সুলতান অমুসলিমদের বিনাশসাধনে উদ্যোগ নেবেন এবং শরিয়তের বিধান মেনে ভারতবর্ষকে দার - উল - ইসলাম অর্থাৎ ইসলামের পবিত্র ভূমিতে পরিণত করবেন । 
iii) হিন্দুদের উপেক্ষা : সুলতানি রাষ্ট্রে অমুসলিম হিন্দুরা উপেক্ষিত ও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়েছিল । তারা ‘জিম্মি’ হিসেবে গণ্য হত এবং তাদের কাছ থেকে ‘জিজিয়া’ কর আদায় করা হত ।


[        ] ‘ ধর্মনিরপেক্ষ ’ বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তি :  

i)  পৃথক রাজতন্ত্র : শরিয়তের বিধান অনুসারে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলেন স্বয়ং ঈশ্বর । তার প্রতিনিধি হলেন প্রথমে হজরত মহম্মদ এবং পরে খলিফা । কিন্তু ভারতের সুলতানি রাষ্ট্রে এই নিয়ম থেকে স্বতন্ত্র রাজতন্ত্র গড়ে উঠেছিল । 

ii) খলিফার প্রতি আপাত আনুগত্য : কোনাে কোনাে সুলতান রাজনৈতিক প্রয়ােজনে খলিফার অনুমতি নিয়েছেন ঠিকই , কিন্তু সেটা ছিল একান্তই সুলতানের ইচ্ছাধীন বিষয় । 

iii) সুলতানের স্বাধীনতা : ইসলামি আইন অনুসারে খলিফা সমগ্র মুসলিম ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রধান হলেও ভারতে এই রীতি গুরুত্ব পায়নি । এখানে সুলতানগণ খলিফার নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে শাসন চালাতে পারতেন । 


iv) হিন্দুদের গুরত্ব : সুলতানি আমলে হিন্দুদের গুরুত্ব একেবারে লুপ্ত হয়ে যায়নি । তখন বহু হিন্দু উচ্চ রাজকার্যে নিযুক্ত হতেন এবং দেশের নানা স্থানে বহু হিন্দু সামন্ত রাজ্যের অস্তিত্বও ছিল ।


v) উলেমাদের সুলতান নির্ভরতা : সুলতানি আমলে উলেমারা সুলতানদের প্রভাবিত করতে পারতেন না , বরং বাস্তবে উলেমারা সুলতানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে কাজ করতেন । 


vi) শরিয়ত বহির্ভূত নির্দেশ : সুলতানি আমলে শরিয়তের নির্দেশ লঙ্ঘন করে বহু কাজ সম্পন্ন হওয়ার উদাহরণও দেখা যায় । 


vii) ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র : উপরােক্ত বিভিন্ন যুক্তির নিরিখে অধিকাংশ পণ্ডিত সুলতানি রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলেই অভিহিত করেন । 


উপসংহার : তাই রাষ্ট্ররূপে দিল্লি সুলতানির প্রকৃতি নির্বাচন করা কিছুটা কঠিন , কারণ ধর্মাশ্রয়ী এবং ধর্মনিরপেক্ষ এই দুই ধরনের রাজতান্ত্রিক প্রবৃত্তিই দেখা গেছে এর মধ্যে । রাজনৈতিক মাপগণ্ডির বিচারেও কেউ কেউ দিল্লি সুলতানিকে কেন্দ্রীভূত এবং কেউ বা আবার বিকেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করেছেন ।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন