ইউরােপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পটভূমি বা প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করাে ।
উত্তর : চার্চগুলির দুর্নীতি : মধ্যযুগের ইউরােপে চার্চগুলি ছিল যাবতীয় দুর্নীতির কেন্দ্রস্থল । প্রচুর ভূসম্পত্তির মালিক হওয়া সত্ত্বেও চার্চগুলিকে কোনােরকম কর দিতে হত না । চার্চের এই বিপুল সম্পদের কারণে যাজকসহ বিভিন্ন পদ ছিল লােভনীয় । অনেকসময় যাজকরা ‘ইনডালজেন্স’ নামে মুক্তিপত্র বিক্রির মাধ্যমেও অর্থ আদায় করতেন । চার্চের এই সমস্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ জন্মায় ।
পােপতন্ত্রের ক্ষমতা লিপ্সা : মধ্যযুগে সমগ্র খ্রিস্টান জগতের ধর্মগুরু হওয়ায় ধর্মযাজকরা ধীরে ধীরে রাজার অভিষেক থেকে শুরু করে রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করা পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেন । অনেকসময় যাজক,রাজা নির্মাতার ভূমিকা নিতেন । পােপ ও উচ্চপদস্থ যাজকদের এই ভূমিকার বিরুদ্ধে রাজা এবং অভিজাত সামন্তরা ক্ষুব্ধ হয় ।
পেপতন্ত্রের অর্থলিপ্সা : পােপরা ধীরে ধীরে অর্থলােভী হয়ে উঠেছিলেন । বিলাসবহুল জীবনযাপন , সুদৃশ্য অট্টালিকা নির্মাণ প্রভৃতির জন্য তাদের প্রচুর অর্থের প্রয়ােজন হয়ে পড়ে । যাজকদের ওপর ধার্য দুই কর ‘অ্যানেটস’ এবং ‘টেথস’ ছাড়া ‘ফাস্টফ্রুট’,‘টাইথ’ , ‘ইনডালজেন্স’ থেকে পােপদের প্রচুর অর্থ আয় হত ।
জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান : দ্বাদশ শতকে সামন্ততন্ত্রের পতনের পথ প্রস্তুত হলে জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান ঘটে ।ইংল্যান্ড, ফ্রান্সসহ ইউরােপের বেশ কিছু দেশের রাজারা ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন । এইসব জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রচনায় সাহায্য করে ।
মুদ্রণযন্ত্রের প্রভাব : মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কারের ফলে নিউ টেস্টামেন্ট , ওল্ড টেস্টামেন্টের সহজ ব্যাখ্যা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত আছে আর হয় । শিক্ষিত শ্রেণি বুঝতে শুরু করে ধর্মশাস্ত্রে আসলে কী বলা আছে, চার্চ তা থেকে সরে গিয়ে কী বলছে । জি . আর . এলটন তাই বলেছেন, “সাধারণ মানুষের বাইবেলপাঠ নবজাগরণের একটি কারণ ।”
যুক্তিবাদের প্রভাব : নবজাগরণপ্রসূত যুক্তিবাদী ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে সাধারণ মানুষ পােপ ,যাজকদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হয় । মানুষ যুক্তিবাদের আলােকে চিন্তা করতে শেখে । প্রচলিত ধ্যানধারণার প্রতি বিশ্বাস, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি মানুষের আনুগত কমতে থাকে ।
ক্যাথলিক ও প্রােটেস্ট্যান্ট দ্বন্দ্ব : ক্যাথলিক ধর্মমতের নানা সংস্কার বা রীতিনীতিগুলি বিতর্কের জন্ম দেয় । মেরি ও খ্রিস্টের মূর্তিপূজা , সন্তদের মূর্তি নিয়ে মাতামাতি ,ক্রুশকেন্দ্রিক সংস্কার , দেহ ও রক্ত পরিবর্তন তত্ত্ব প্রভৃতি বিষয় যুক্তিবাদী মানুষেরা মেনে নিতে পারেননি । প্রােটেস্ট্যান্টদের মুক্তিতত্ত্ব সাধারণের মনে চার্চবিরােধী মনােভাব গড়ে তুলেছিল । প্রােটেস্ট্যান্টদের মতে , সৎকর্ম ও আরাধনার মাধ্যমে পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় । পােপ মানুষকে মুক্তি দিতে পারেন না ।
পণ্ডিত ও মানবতাবাদীদের সমালােচনামূলক ভূমিকা : ইংল্যান্ডের জন ওয়াইক্লিফ , বােহেমিয়ার জন হাস , ফ্রান্সের পিটার ওয়ালভাে , ইটালির জিওলামাে সাভােনারােলা ,হল্যান্ডের ডেসিডােরিয়াস এরাসমাস প্রমুখ মানবতাবাদীগণ চার্চ ও পােপতন্ত্রের বিভিন্ন দুর্নীতির সমালােচনা করে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন ।
কোন মন্তব্য নেই