শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে নরেন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎকারের ঘটনা বিবৃত করাে
উত্তর : শ্রী যতীন্দ্রবিমলচৌধুরী বিরচিত ‘ভারতবিবেক’ নাট্যাংশে শ্রীরামকৃয়দেব কলিকাতার সিমুলিয়া অঞ্চলে গিয়েছেন গৃহীভক্ত সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের গৃহে । সঙ্গে আছেন ভক্তবৃন্দ ।সেদিন ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের এক মধুর সন্ধ্যা । সন্ধ্যা সাত ঘটিকা । শ্রীরামকৃষ্ণ সাধক — জগজ্জননী ভবতারিণীর পূজারী । ভবতারিণীই তাঁর ধ্যান - জ্ঞান । শয়নে -স্বপনে -নিদ্রায়-জাগরণে তিনি শ্রীশ্রীমাতার পুণ্য স্মরণে তন্ময় । সুরেন্দ্রনাথের গৃহেও সেই ভাবােদয় । তিনি মাতৃকাস্তুতি শােনার জন্য ব্যাকুল । তিনি সুরেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন যে ,তাঁরই ( সুরেন্দ্রের) প্রতিবেশী নরেন্দ্রনাথ নামে এক তরুণ গায়ক আছেন । তিনি দত্তকুলােদ্ভব, অধ্যয়নরত এবং ব্রাহ্বসমাজের সঙ্গে যুক্ত । তরুণ হলেও তিনি সত্যই সংগীতনিপুণ । নরেন্দ্রের নাম শােনামাত্র শ্রীরামকৃষ্ণদেব ব্যাকুল হয়ে পড়লেন ।নরেন্দ্র অর্থাৎ নরশ্রেষ্ঠ । শ্রীরামকৃষ্ণ যে তাঁর হৃদয়রাজ্যে একজন যথাযােগ্য , সর্বলােকবরেণ্য উত্তরসাধককে খুঁজে বেড়াচ্ছেন , এই কি সেই জটাজুটধারী ! জগতের কল্যাণকারী ! মন্দাকিনীর কলকলধারায় সুস্নাত শিবশংকর — যাঁর অপেক্ষায় শ্রীশ্রীঠাকুর (রামকৃষ্ণদেব ) দিন গুনছেন — যাঁর পথ চেয়ে অধীর আগ্রহে সময় কাটাচ্ছেন ? শ্রীরামকৃয় অধীর হয়ে উঠলেন ওই যুবকটিকে দেখার জন্য , তাঁর সুমধুর কণ্ঠে মাতৃস্তুতি শােনার জন্য শ্রীরামকৃষ্ণের আগ্রহাতিশয্যে সুরেন্দ্রনাথ তাঁকে আনার জন্য সত্বর যাত্রা করলেন এবং নরেন্দ্র সমভিব্যাহারে প্রত্যাবর্তন করলেন ।
শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎকার ঘটল নরেন্দ্রনাথের । হল মণিকাঞ্চনযােগ । উভয়ে উভয়কে প্রত্যক্ষ করলেন । প্রথম দর্শনেই নরেন্দ্রনাথকে কিছুটা পর্যাকুল দেখা গেল । শ্রীরামকৃষ্ণ সেই কোমলকুঞ্চিতকেশী , সুসজ্জশিরস্ক ,ইন্দীবরতুল্য আকৰ্ণবিস্তৃত চক্ষুবিশিষ্ট যুবকের প্রতি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন । নরেন্দ্রনাথেরও মন সন্দিগ্ধ হলেও তার মন যেন তাকে বলে দিচ্ছে ইনিই তাঁর হৃদয়ানন্দকারী স্নিগ্ধ-সুন্দর চন্দ্র । উভয়েই উভয়ের প্রতি আকৃষ্ট । শ্রীরামকৃষ্ণের হৃদয়তটিনী নরেন্দ্ররূপ সাগরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে । সে -গতি অবাধ - অপ্রতিরােধ্য । নরেন্দ্রনাথেরও তদ্রুপ অবস্থা । তিনি নিজেকে সংযত করতে পারছেন না । তাঁরও হৃদয়চকোর শ্রীরামকৃষ্ণরূপ পূর্ণশশীর আনন্দরশ্মি আশা মিটিয়ে পান করছে । নরেন্দ্রের চোখে শ্রীরামকৃষ্ণ কোটি সূর্যসমপ্রভ কোটি চন্দ্র সুশীতল । চুম্বক যেমন লােহাকে আকর্ষণ করে শ্রীরামকৃষ্ণও তেমনি নরেন্দ্রকে আকর্ষণ করছেন ।
তথাপি নরেন্দ্র নব্য শিক্ষায় শিক্ষিত । তিনি সম্বিত ফিরে পেলেন । অবলম্বন করলেন মানসিক দৃঢ়তা । মানবশরীরে ভাগবতসত্তা তিনি আরােপ করার ব্যাপারে অবিশ্বাসী । মানুষ ভগবান হতে পারে না । ভগবানও মানুষ হয়ে আসেন না । ক্ষণিকের চিত্তচাঞ্চল্যের জন্য তিনি নিজেকে ধিক্কার দিলেন । ধিক্কার দিলেন তাঁর অধীত বিদ্যাকে । শ্রীরামকৃষ্ণের মন ইঙ্গিত দিচ্ছে যে , এই ব্যঢ়োরস্ক, করিকরনিন্দিত ভুজযুগধারী , আয়তনয়ন এই যুবকই তাঁর কাঙ্ক্ষিত উত্তরসাধক । মা ভবতারিণী সুযােগ্য সন্তানকেই তাঁর কাছে পাঠিয়েছেন ।
অতঃপর চিত্তবিনােদনের জন্য তিনি নরেন্দ্রকে গান গাইতে অনুরােধ করলে নরেন্দ্র গান শুরু করলেন । গানের বিষয়বস্তু শ্মশানবাসিনী , নৃমুণ্ডমালিনী , শক্তিস্বরূপিনী শ্যামা । নরেন্দ্রের কণ্ঠ মধুবর্ষী, ভাষা ভক্তিরসাপ্লুত । শ্রীরামকৃষ্ণ অভিভূত । মা ভবতারিণীর কাছে তাঁর পুনরায় প্রার্থনা এই যুবকই যেন তাঁর , উত্তরসাধক হয় , যে হবে সর্বজনবরেণ্য এবং দেশের কালিমা দূর করতে সক্ষম ।
কোন মন্তব্য নেই