তােমাদের পাঠ্যাংশে কবি বিরহী যক্ষের যে- চিত্র এবং তার অন্তর্বেদনার করুণ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলেছেন , তা ব্যক্ত করাে
উত্তর : পাঠ্যাংশের প্রথমেই আমরা ‘মেঘদূতম ’-এর বিরহী যক্ষের পরিচয় পাই । অলকাধিপতি যক্ষরাজ কুবেরের সে ছিল এক অনুচর । তরুণী প্রিয়ার প্রথম প্রেমের প্রবল আবেগে অভিভূত যক্ষের প্রভুর কাজে অবহিত থাকা সবসময় সম্ভব নয় । ফলে যক্ষ কর্তব্যকর্ম ঠিক ঠিক সম্পাদন করতে না -পারায় প্রভুর দ্বারা অভিশপ্ত হল । তার সকল মহিমা খর্ব করে তাকে এক বছরের জন্য অলকা থেকে রামগিরির আশ্রমে নির্বাসিত করা হল । অসহায় যক্ষ রামগিরিতে অবস্থান করলেও তার মন পড়ে রইল অলকায় —যেখানে তার প্রাণপ্রিয়া একাকী নয়নাশ্রুবর্ষণ করে কালযাপন করছে । গুরু বিরহভার অন্তরে বহন করে গভীর মনস্তাপে যক্ষের দিন কাটছিল । প্রিয়ার জন্য ভেবে ভেবে সে একেবারে শীর্ণ হয়ে গেছে ।
বালা ঢিলে হয়ে কখন যে মণিবন্ধ থেকে খসে পড়েছে সে-বিষয়ে যক্ষের খেয়ালই নেই । সে অস্থির চঞ্চল । রামগিরির কোনাে একটি আশ্রমে সে স্থায়ীভাবে বাস করতে পারছে না। আশ্রম থেকে আশ্ৰমান্তরে ঘুরে ঘুরে কাটায় । সেইজন্য কবি লিখেছেন “রামগির্যাশ্রমেষু” । রামগিরির প্রত্যেক চূড়ায় শ্রীভগবান রামচন্দ্রের সুচারু পাদপদ্ম অঙ্কিত রয়েছে । তার প্রত্যেক গিরিনিঝরিণীটি জনকতনয়ার পবিত্র । অঙ্গস্পর্শে পুণ্যোদক হয়ে উঠেছে । প্রতিটি মুহূর্তে বিরহব্যথাতুর যক্ষকে রাম - সীতার মিলনানন্দে অরণ্যবাসের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে রামগিরি তাকে অধিকতর আকুল করে তুলেছিল ।
নিবিড় - ঘন - ছায়াতরু ঘেরা রামগিরি আশ্রম এক রমণীয় । পার্বত্যকুঞ্জ হলেও ওই কুঞ্জ তাকে সুখ দিতে পারেনি । সে দিনের - পর -দিন রামগিরি শিখরে বসে উত্তরে অলকার পানে চেয়ে স্তব্ধ হয়ে মনে মনে শুধু প্রিয়তমার স্বপ্ন রচনা করে । নিদারুণ বিরহ যন্ত্রণায় যক্ষ যতই কাতর হয়ে পড়ে , ততই তার ভাবনা হচ্ছে সেই গৃহে ফেলে আসা বিরহিণী তরুণী প্রিয়ার জন্য, তার ভয় হয় এত বিরহ যন্ত্রণা সহ্য করে তার প্রিয়া জীবন ধারণ । করতে পারবে তাে ? শাপান্তে ফিরে গিয়ে সে তার প্রিয়াকে জীবন্ত দেখতে পাবে তাে ? কোনােরকমে প্রিয়ার কাছে তার কুশলময়ী বার্তা এবং শাপাবসানের দিনটি জানাতে পারলে যক্ষ আশ্বস্ত হয় । কিন্তু এই দুর্গম পথে কাকেই বা পাঠায় ? এমন সময় পূর্বাকাশে আষাঢ়ের প্রথম ঘনঘটা দেখা দিল । আষাঢ়ের প্রথম দিবসে মেঘকে আকাশে সঞ্চারিত হতে দেখে চেতন - অচেতনের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে যক্ষ মেঘকেই তার দূতরূপে অলকায় পাঠাবার থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল । যক্ষ যে এখন প্রেমােন্মত্ত, মিলনের জন্য অধীর ও আত্মহারা । তার কাছে চেতন - অচেতনের ভেদাভেদ দূর হয়ে গেছে । অতএব , সদ্যপ্রস্ফুটিত কুটজ কুসুমের অর্ঘ্য সাজিয়ে সে মেঘকে স্বাগত জানাল ।
কবি কালিদাস যক্ষের অন্তর্বেদনাকে যেভাবে পরিস্ফুট করেছেন , তা শুধু মেঘদূতের যক্ষের অন্তর্বেদনা নয়, বিশ্বের সকল বিরহীর এক মর্মন্তুদ বিরহবেদনা , বেদনভরা হৃদয়ের এক অব্যক্ত আর্তি ।
কোন মন্তব্য নেই