শুক্রবার, ২০ আগস্ট, ২০২১

মানবতাবাদ কী ? রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে বিশ্ব মানবতাবাদের তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর ?

 

একাদশ শ্রেণী দর্শন class xi 11 eleven philosophy মানবতাবাদ কী রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে বিশ্ব মানবতাবাদের তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর manobotabad ki robindronather drishtitey bisw manobotabader tatporjo bakkha koro

 প্রশ্ন: মানবতাবাদ কী ? রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে বিশ্ব মানবতাবাদের তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর ?


উত্তর:- মানবের যে ধর্ম তাই মানবধর্ম । ধর্ম হল তাই যে বিশেষ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে মানুষকে ঘিরে থাকে । " মনুষ্যত্ব " এর সমার্থক শব্দ হল মানবতাবাদ , মানুষের মধ্যে যে দয়া ,মায়া , প্রেম ,ভালোবাসা প্রভৃতি গুন বর্তমান , তাকেই মানবতাবাদ বলা হয় । যুগে যুগে আবির্ভূত হয়েছেন মনীষীরা । তাঁরা ব্যক্ত করেছেন মানবসেবায় বিচিত্র পথের কথা ।

সব মানুষের মধ্যে যে " সমান ধর্ম " থাকে তাকে " মনুষ্যত্ব " বলে । এই মনুষ্যত্ব ধর্মের জন্যই আমরা অন্যান্য প্রাণী থেকে ভিন্ন বলে দাবী করি । মানুষের মনের ভিতরে যে দয়া , মায়া , প্রেম , প্রীতি ও ভালোবাসা প্রভৃতি মানবোচিত গুন বা বিশিষ্টতা তাকেই মনুষ্যত্ব বা মানবতা বলে । আর মানবতা সম্পর্কিত যে মতবাদ , তাই মানবতাবাদ । 


রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে বিশ্বমানবতাবাদ : রবীন্দ্রনাথের জীবন দর্শনেও মানবতাবাদের একটা বিশেষ ভূমিকা আমরা লক্ষ করি । তবে " জাগতিক বিবর্তনেও যে কাহিনী বিজ্ঞান আমাদের গোচরে এনেছে , অথবা মানুষের আবির্ভাব , ক্রমবিকাশ প্রভৃতির পশ্চাতে জৈবিক বিবর্তনের যে বিচিত্র ইতিহাস বিজ্ঞান আবিস্কার করেছে রবীন্দ্রনাথের মানবিক উপলব্ধি সেই সত্যকে আশ্রয় করে গঠিত বা বিকশিত হয়নি অথবা আধুনিক কালে দর্শন চিন্তা মানুষকে তাঁর সমগ্র কর্মের কর্তা , তার সমগ্র অস্তিত্বের নিয়ামক রূপে নির্ধারণ করে তাকে যে মর্যাদা দান করেছে , রবীন্দ্র মানস সেই ভাবনা দ্বারাও প্রভাবিত হয়নি । তাঁর উপলব্ধিতে মানবিক ঐশ্বযের স্বরূপ অন্য প্রকার । উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্যে মানবতাবাদ শব্দটি এসেছে । 

মানুষের ধর্ম Religion of Man ও গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ মানুষ , মনুষ্যত্ব ও মানবতা বিষয়ে তাঁর অভিনব অভিমত ব্যক্ত করেছেন । বইটির ভূমিকায় তিনি জানিয়েছেন , মানুষের দুটি দিক আছে । একটা দিক বিষয় বুদ্ধি নিয়ে নিজের সিদ্ধি খোঁজে সেখানে সে জীব হয়েই বাঁচতে চায় । আর একটা দিক ব্যাক্তিগত প্রয়োজনের সীমা ছাড়িয়ে ব্যক্তিস্বার্থের প্রবর্তনাকে অস্বীকার করে । সেখানে সে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের চেয়ে বড়ো জীবন বাঁচতে চায় । স্বার্থ আমাদের যেদিকে ঠেলে নিয়ে যায় , তাঁর মূল প্রেরণা মেলে সমস্ত জীব প্রকৃতিতে , কিন্তু মানুষ মরণশীল ও মুনি বলেই সে বুঝেছে যা আমাদের ত্যাগের ও তপস্যার দিক নিয়ে যায় , তাই হল মনুষ্যত্ব অর্জন করার জন্য সাধনার প্রয়োজন ।


আদর্শ মানুষের স্বরূপ : রবীন্দ্রনাথ মনে , মানুষের দায় হল মহামানবের দায় কোথাও তার সীমা নেই । মহামানব হল আদর্শ মানুষ বা আদর্শ মানবতা মানুষ তার সীমার গন্ডি পেরিয়ে যা হতে চায় , তাই । আদর্শ মানুষ বা মানবতা বিশেষ কোনো এককালে ব্যাপ্ত নয় , তা ত্রিকাল ব্যাপ্ত । মানুষের বিশ্বাস যে , ব্যক্তি মানুষ রূপে তার মৃত্যু হলেও , যে আদর্শ মানবতার জন্য তার নিরলস প্রচেষ্টা , নিরলস সাধনা , তার মৃত্যু নেই । সর্বকালের সকল মানুষের মধ্যে সেই এক আদর্শ মানুষ বা মানবতা নিত্যকাল বিরাজিত । সেই আদর্শ মানবকে উপলব্ধি করাই হল এযাবৎ মানুষের সাধনা , তার ধর্ম । এই আদর্শ মানব ব্যক্তিমানব থেকে স্বতন্ত্র । তিনি মানুষের অন্তরে আছেন , কিন্তু ব্যক্তি মানব কে অতিক্রম করে আছেন । তিনি সকল মানুষের মধ্যে বিরাজমান ।

পূর্ন মানব স্বরূপের মধ্যেই আছে মনুষ্যত্ব ও মানবতা : এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য হল " আমাদের অন্তরে এমন কেউ আছেন যিনি মানব , অথচ যিনি ব্যাক্তিগত মানবকে অতিক্রম করে সর্বজনীন সর্বকালীন মানব । সর্বজনীনতার আবির্ভাব ।" মনীষীরা তাঁকে সব মানুষের মধ্যে অনুভব করেন । তাঁকে ভালোবেসে জীবন দিতে পারেন । সেটা না পারলে মানুষ সত্যিকার মানুষ হয় না । তাঁর আকর্ষণে মানুষ অন্তর থেকে কাজ করছে বলেই নিজেকে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে গিয়ে বার বার সীমাকে অস্বীকার করছে । সেই অন্তর মানবকেই মানুষ বিভিন্ন নামে পূজা করছে । নিজের বিচ্ছিন্নতাকে অতিক্রম করে সমস্ত মানুষের ঐক্যের মধ্যে তাঁকে পাবে বলে মানুষ প্রাথনা জানিয়ে চলেছে বলে সেই মানব , সেই দেবতা , যিনি এক ও অদ্বিতীয় । " মানুষের ধর্ম " গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ মানুষের অন্তর দেবতার স্বরূপ সেই এক ও অদ্বিতীয় মানুষের কথাই নানাভাবে ব্যক্ত করেছেন ।


মানবতার গুরুত্ব : রবীন্দ্রনাথ মনে করেন যে , মানবতার উপলব্ধির মাধ্যমে মনুষ্যত্ব অর্জন করে খন্ড সীমাকে ছাড়িয়ে অখন্ড অসীমের দিকে ধাবিত হয় । সে  নিজের সম্পর্কে ভাবে সহহম অর্থাৎ আমিই সেই । এই সেই আসলে বিশ্বমানব , সর্বজনীন ও সর্বকালীন মানব । এই মানবতার উপলব্ধি হলেই মানুষ তার সংক্রিন গন্ডি অতিক্রম করে বিশ্বমৈথির প্রাঙ্গণে পৌঁছে যায় ।

রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি লেখায় আমরা এই মানবতাকে বা মানব ধর্ম কে খুঁজে পায় । মানুষের ব্যাথা ও বেদনার অনেক কারণ , এই দুঃখ বেদনা শুধুমাত্র সরকারী দাক্ষিণ্য বা আইন প্রণয়ন করে দূরে করা সম্ভব নয় । এ জন্য ভালো মানুষের দরকার । মানব সেবার কাজে সবাইকে নিযুক্ত হতে হবে । আইন করে মানব ধর্ম রক্ষা করা যায় না , তার জন্য হৃদয়ের প্রসার দরকার । আমরা সবাই ছোটোবেলা থেকে জাতীয় সংগীত " জনগনমন অধিনায়ক ...." গানটির সঙ্গে পরিচিত , এই গানটির আসল অর্থ অনুধাবন করতে পারলে আমাদের অনেক দুঃখ কষ্ট দূর হওয়া সম্ভব । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গানের মাধ্যমে জনগণ কে অধিনায়ক মনে করেছেন , জনগণের মধ্যে এক অফুরন্ত শক্তি আছে , যা আমাদের সমাজকে তথা আমাদের ভারতবর্ষ কে উন্নত জায়গায় নিয়ে যেতে পারে । আর এ চেষ্টা আমাদেরকেই করতে হবে । আসলে মানব ধর্মের চরমোৎকর্ষের পরিচয় সেখানেই পাওয়া যায় যেখানে মানুষ ভাবতে পারে -


       “ সকলের তরে সকলে আমরা 

        প্রত্যকে আমরা পরের তরে ।”



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন