অভিজ্ঞতাবাদ কাকে বলে ? জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে অভিজ্ঞতাবাদের মূল বক্তব্যগুলি আলােচনা করাে ।
উত্তর : জ্ঞানের উৎস সম্পর্কিত মতবাদের পরিপ্রেক্ষিতে যে সমস্ত মতবাদের উল্লেখ করা যায়, তাদের মধ্যে অভিজ্ঞতাবাদ হল একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ । অভিজ্ঞতাবাদ মূলত বুদ্ধিবাদের একটি বিরােধী মতবাদরূপেই গণ্য । অভিজ্ঞতাবাদের মূল বক্তব্য হল ,আমাদের ইন্দ্রিয় সংবেদন তথা অভিজ্ঞতাই হল জ্ঞানের একমাত্র উৎস । অভিজ্ঞতা বাদ বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাকে বর্জন করে শুধুমাত্র ইন্দ্রিয় সংবেদন তথা অভিজ্ঞতাকেই জ্ঞানের মৌল উৎসরূপে দাবি করে । অভিজ্ঞতাবাদের সমর্থকদের বলা হয় অভিজ্ঞতাবাদী ।
[ ] চরমপন্থী বা নরমপন্থী যাই হােক না কেন , সমস্ত অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকদের বক্তব্যের মধ্যেই কয়েকটি মূল সুর ধ্বনিত হয় ৷ সেগুলিকেই অভিজ্ঞতাবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়রূপে গণ্য করা হয় । অভিজ্ঞতাবাদের মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি নীচে উল্লেখ করা হল ।
[ ] জ্ঞানের মুখ্য উৎস হিসেবে অভিজ্ঞতা : অভিজ্ঞতাবাদ অনুযায়ী ইন্দ্রিয় সংবেদন তথা অভিজ্ঞতাই হল জ্ঞানের মুখ্য উৎস । এই ইন্দ্রিয়ানুভবকে বাদ দিয়ে কখনােই জ্ঞান লাভ করা যায় না । অভিজ্ঞতাবাদীদের মতে , বিশুদ্ধ প্রজ্ঞা বা বুদ্ধি বলে স্বতন্ত্র কোনাে বিষয় নেই । বাস্তবের সমস্ত জ্ঞানই অভিজ্ঞতানির্ভর ।
[ ] জ্ঞানের একমাত্র পদ্ধতি হিসেবে আরােহাত্মক পদ্ধতি : অভিজ্ঞতাবাদ অনুযায়ী জ্ঞানের একমাত্র পদ্ধতি হল আরােহাত্মক পদ্ধতি , কখনােই অবরােহাত্মক পদ্ধতি নয় । কারণ , আমরা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা করে একটি সাধারণ সূত্র বা ধারণায় উপনীত হই । সুতরাং , সমস্তপ্রকার সামান্য ধারণাকেই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব ।
[ ] সহজাত ধারণার বিষয়টিকে বর্জন : অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকগণ বুদ্ধিবাদের মূলভিত্তি অর্থাৎ সহজাত ধারণার বিষয়টিকে নস্যাৎ করেছেন । তাদের মতে , সহজাত ধারণা বলে কোনাে কিছুই থাকতে পারে না । কারণ , সহজাত ধারণার বিষয়কে কখনােই ইন্দ্রিয় সংবেদনের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায় না । তাদের মতে, আমাদের সমস্ত ধারনাই প্রাপ্ত হয় ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে । তারা আরও দাবি করেন যে, জন্মাবার সময় আমাদের মন থাকে সাদা কাগজের মতাে । অভিজ্ঞতার দ্বারাই সেখানে সমস্ত ধারণা মুদ্রিত হয় , অন্য কোনাে উপায়ে নয় । সুতরাং সহজাত ধারণা তথা আন্তর ধারণার বিষয়টি অবশ্যই পরিত্যাজ্য ।
[ ] অভিজ্ঞতাবাদীদের স্বীকার্য বাক্য : অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকগণ দু-ধরনের বাক্যকে স্বীকার করে নিয়েছেন— [i] বিশ্লেষক এবং [ii] সংশ্লেষক । যে সমস্ত বাক্য বিশ্লেষকরূপে গণ্য,তা অবশ্যই পূর্বতঃসিদ্ধ হবে । আবার যে সমস্ত বাক্য সংশ্লেষকরূপে গ্রাহ্য, তা অবশ্যই পরতঃসাধ্যরূপে গণ্য হবে । এ দুটি ছাড়া তৃতীয় কোনাে প্রকার বাক্যকে অভিজ্ঞতাবাদীরা স্বীকার করেন না । বুদ্ধিবাদীরা যে পূর্বতঃসিদ্ধ সংশ্লেষক বচনের উল্লেখ করেছেন , তাকে অভিজ্ঞতাবাদীরা বর্জন করেছেন ।
[ ] মূল্যের বাস্তব সত্তাকে অস্বীকার : অভিজ্ঞতাবাদীরা দাবি করেন যে, মূল্যের কোনাে বাস্তব সত্তা নেই । তারা সত্য , শিব ও সুন্দর রূপ মূল্যকে অস্বীকার করেছেন এবং পরমমূল্যের বিষয়কে নিছক কল্পনারূপে অভিহিত করেছেন । কারণ , ইন্দ্রিয় সংবেদন দ্বারা এই সমস্ত মূল্যের মূল্যায়ন কখনােই সম্ভব নয় ।
[ ] অধিবিদ্যাকে অস্বীকার : অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকগণ অধিবিদ্যাকে অর্থহীনরূপে উল্লেখ করেছেন । তাঁদের মতে , অধিবিদ্যার জ্ঞান কখনােই ইন্দ্রিয় সংবেদনের মাধ্যমে লভ্য নয় । সেকারণেই তারা অধিবিদ্যাকে অসম্ভব , উদ্ভট ও আজগুবিরূপে উল্লেখ করেছেন এবং অধিবিদ্যক বাক্যসমূহকে অর্থহীনরূপে গণ্য করেছেন ।
[ ] জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ হিসেবে অভিজ্ঞতাবাদ শুধুমাত্র ইন্দ্রিয় সংবেদন তথা অভিজ্ঞতার ওপরই গুরুত্ব আরােপ করেছে । বুদ্ধিবাদের বিরােধী মতবাদরূপে গণ্য হওয়ায় তা বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার বিষয়টিকে অস্বীকার করেছে । এর ফলে তা একদেশদর্শিতার দোষে দুষ্ট হয়েছে । কিন্তু জ্ঞানােৎপত্তির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা ছাড়া বুদ্ধিরও যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে , তা আদৌ অস্বীকার করা যায় না । বরং এই দাবি করা সংগত যে , জ্ঞানােৎপত্তির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার যতটা ভূমিকা আছে , বুদ্ধিরও ঠিক ততটাই ভূমিকা রয়েছে ।সুতরাং জ্ঞানের উৎপত্তির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাবাদ কখনােই একটি পূর্ণাঙ্গ মতবাদরূপে গণ্য হয় না ।
কোন মন্তব্য নেই