ইতিহাস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ইতিহাস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই, ২০২২

ভারতীয় উপমহাদেশের অর্থনীতিতে ইন্দো রোম বাণিজ্যের প্রভাব কী ছিল ? তৃতীয় নগরায়ণের কারণ কী ছিল ?

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer ভারতীয় উপমহাদেশের অর্থনীতিতে ইন্দো রোম বাণিজ্যের প্রভাব কী ছিল তৃতীয় নগরায়ণের কারণ কী ছিল bharotiyo upomohadesher arthonoitite indorom bannijer provab ki chilo tritiyo nogorayoner karon ki chilo


উত্তর : ইন্দো  রােম বাণিজ্যের প্রভাব পড়েছিল ভারত এবং রােম উভয় দেশের ওপরই । ভারত ও পাশ্চাত্য উভয় দেশই মূলত মৌর্যোত্তর যুগের সময়কালে বাণিজ্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল ।  

[       ] ভারতের ওপর 

i) সমৃদ্ধশালী নগরের উদ্ভব : ইন্দো রােম অর্থাৎ ভারত রােম বাণিজ্যের সুবাদে সাতবাহন শাসনাধীন দাক্ষিণাত্যে ও কুষাণ শাসনাধীন উত্তর ভারতে বেশ কিছু সমৃদ্ধশালী নগরের উদ্ভব ঘটে । দক্ষিণ ভারতে উদ্ভব ঘটেছিল এমন কয়েকটি নগর হল অমরাবতী , পৈঠান , সােপারা , কাবেরীপত্তনম প্রভৃতি । উত্তর ভারতে উদ্ভব ঘটেছিল এমন কয়েকটি নগর হল - মথুরা , কৌশাম্বী ,বারাণসী । 


ii) শিল্পসংস্কৃতি : বাণিজ্যের ফলে রােমান শিল্প সংস্কৃতির দ্বারা ভারতীয় শিল্প সংস্কৃতি প্রভাবিত হয় ।বিশেষত শিল্পের ওপর গ্রিক রােমান শিল্প ও স্থাপত্যশৈলীর যথেষ্ট প্রভাব পড়ে । ফলে ভারতে গান্ধার শিল্প নামে এক নতুন শিল্পরীতির উদ্ভব ঘটে । 
[        ] রােমের ওপর 

i) চিকিৎসাবিজ্ঞানে : রােম ভারত বাণিজ্যের সুবাদে রােমে ভারতীয় চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক ধারণার অনুপ্রবেশ ঘটে । ভারতীয়দের লতা গুল্মভিত্তিক ভেষজ চিকিৎসাজ্ঞানের পরিচয় লাভ করে রােমানরা । 

ii) মশলার ব্যবহার : রােম ভারত বাণিজ্যের সুবাদে রােমের বণিকরা দক্ষিণ ভারত থেকে মশলা কিনে দেশে নিয়ে যেত । রােমে ভারতীয় মশলার বিশেষ চাহিদা ছিল । ভারত থেকে বিভিন্ন প্রকারের মশলা রােমে রপ্তানি হওয়ার ফলে রােমানদের রন্ধনপ্রণালী এবং খাদ্য তৈরিতে উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন আসে ।  

[         ] প্রাচীন ভারতে সর্বপ্রথম হরপ্পা সভ্যতার যুগে নগর সভ্যতার সূচনা হয় । দ্বিতীয় পর্যায়ে যােড়শ মহাজনপদের যুগে এবং তৃতীয় পর্যায়ে আদিমধ্যযুগে বহু নতুন নতুন নগরের উদ্ভব হয় । প্রাচীন ভারতে নগরের উদ্ভবের বিভিন্ন কারণ ছিল । যেমন  


(১) গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র গড়ে ওঠা : ড .রামশরণ শর্মার মতে , সামরিক ছাউনি , প্রশাসনিক কেন্দ্র, যাতায়াতের কেন্দ্র, শিল্পী ও কারিগরদের বসবাস প্রভৃতি স্থানে জনসমাগম বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সেখানে ক্রমে নগরের বিকাশ ঘটে । 

(২) ধর্মথনের আকর্ষণ : প্রাচীন ভারতে ধর্মীয় কারণে বিভিন্ন ধর্মস্থানগুলিকে কেন্দ্র করে নগরজীবন প্রতিষ্ঠিত হয় । শ্রাবস্তী , বারাণসী , গয়া, রাজগৃহ , নালন্দা , পাটলিপুত্র প্রভৃতি স্থানগুলির সঙ্গে বুদ্ধের ধর্মপ্রচার ও নির্মাণের বিষয় যুক্ত হয়ে এগুলি জনপ্রিয় নগরে পরিণত হয় । 


(৩) কৃষি , বাণিজ্য ও শিল্পের বিকাশ : ড , কোশাম্বী ও ড . শর্মা দেখিয়েছেন যে , লােহার লাঙল ব্যবহারের ফলে কৃষিক্ষেত্রে উদবৃত্ত উৎপাদন সম্ভব হয় । উদ্বৃত্ত কৃষি পণ্যের ওপর ভিত্তি করে ব্যাবসাবাণিজ্য ও কারিগরি শিল্পের সূচনা এবং এই কেন্দ্রগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সেখানে নগরের উন্মেষের পটভূমি তৈরি হয় । 


(৪) রাজনৈতিক আধিপত্য : ঐতিহাসিক অমলানন্দ ঘােষ মনে করেন যে , রাজতন্ত্রের সূচনার পর রাজা তার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কৃষকের উদ্বৃত্ত পণ্যের বড়াে অংশ দখল করে নেয় । এভাবেই গাঙ্গেয় উপত্যকায় রাজার রাজনৈতিক আধিপত্য বৃদ্ধিপায় । বিভিন্ন স্থানে রাজকীয় প্রশাসনিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় । এই কেন্দ্রগুলি ক্রমে নগরায়ণের পথ প্রশস্ত করে ।






সোমবার, ১৮ জুলাই, ২০২২

বৈদিক যুগের বর্ণপ্রথার উদ্ভবের পটভূমি ও কারণ উল্লেখ করো ।

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer বৈদিক যুগের বর্ণপ্রথার উদ্ভবের পটভূমি ও কারণ উল্লেখ করো broidikyuger bornoprothar udvober potobhumi o karon ullekh koro


উত্তর :  আর্যরা যখন ভারতে আসে তখন তাদের সমাজে কোনােরূপ বর্ণব্যবস্থার অঞলে ছিল না । তারা ভারতে নিজেদের ‘সপ্তসিন্ধু’ অস্তিত্ব অঞ্চলে স্থায়ীভাবে নিজেদের বসতি স্থাপন করলেও ক্রমে তাদের বসতি অঞ্চল প্রসারিত হলে তাদের সঙ্গে ভারতীয় অনার্যদের দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ।
বর্ণভেদপ্রথা বিষয়ক ধারণা : আর্যদের গায়ের রং ছিল ফরসা এবং অনার্যদের ছিল কালাে । এই ব্যবধানকে স্থায়ী করার উদ্দেশ্যে আর্যরা সমাজজীবনে বিভিন্ন পেশা বা বৃত্তি অনুসারে বিভিন্ন গােষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করে । এভাবে বৈদিক সমাজে বর্ণভেদ প্রথার উত্থান ঘটে । তাই ইতিহাসবিদ রাপসন বলেছেন যে, আর্য সমাজে ‘বর্ণ’ শব্দটি গায়ের রং বােঝাতেই ব্যবহৃত হত । আর্যরা ভারতীয় কৃষ্ণাঙ্গদের অনার্য বা দস্যু বলত । তারা নিজেদের বর্ণের শ্রেষ্ঠত্ব এবং সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য সামাজিক রীতিনীতি , বিবাহ প্রভৃতি সম্পর্ক নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল । 


চতুর্বর্ণের উৎপত্তি : ঋগবেদের দশম মণ্ডলের পুরুষসুক্তে একটি শ্লোকে বলা হয়েছে যে ,আদি পুরুষ ব্ৰত্মারমুখমণ্ডল থেকে ব্রাত্মণ, বাহুদ্বয় থেকে ক্ষত্রিয়,উরুদেশ থেকে বৈশ্য ও চরণযুগল থেকে শূদ্রের উৎপত্তি হয়েছে । এভাবে আর্য সমাজে ব্রাক্ষ্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য ও শূদ্র—এই চারটি বর্ণের  সৃষ্টির কথা জানা যায় ।

[        ] ঋবৈদিক যুগে আর্য সমাজে বর্ণ প্রথার উদ্ভব ঘটে । পরবর্তী বৈদিক যুগ থেকে এই বর্ণপ্রথার তীব্রতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে । ঐতিহাসিকদের মতে , আর্য সমাজে বর্ণভেদ প্রথার উদ্ভব ঘটার বিভিন্ন কারণ ছিল । এই কারণগুলি হল  


i) অনার্যদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখা : গৌরবর্ণ ও দীর্ঘকায় আর্যদের চোখে খর্বকায় ও কৃয়বর্ণ অনার্যরা ছিল হীন বা নিকৃষ্ট । ক্রমে কৃষ্ণকায় অনার্যদের সঙ্গে গৌরবর্ণ আর্যদের সহাবস্থানের ফলে তাদের মধ্যে সামাজিক রীতিনীতির সংমিশ্রণ ঘটতে থাকে । সেই কারণেই অনার্যদের থেকে নিজেদের পৃথক অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য আর্যরা তাদের সমাজে বর্ণভেদ প্রথা চালু করার প্রয়ােজন বােধ করে ।  

ii) শ্রমবিভাজনের প্রয়ােজন : আর্যদের বসতির ক্রমশ প্রসার ঘটতে থাকলে কোনাে একজন আর্য পুরুষের পক্ষে জীবন জীবিকার প্রয়ােজনীয় সব কাজ করে ওঠা সম্ভব হচ্ছিল না । যে সারাদিন যুদ্ধের কাজে নিযুক্ত থাকত তার পক্ষে কৃষি বা বাণিজ্যের কাজ করা সম্ভব ছিল না । এভাবে প্রয়ােজনের তাগিদে আর্য সমাজে শ্রমবিভাজনের সূচনা হয় এবং এক একজন ব্যক্তি বংশানুক্রমিকভাবে নির্দিষ্ট একটি পেশা বা বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে । এভাবে বিভিন্ন পেশার মানুষের মধ্যে সামাজিক ভেদাভেদ আরও বৃদ্ধি পায় । আর্যদের মধ্যে এভাবে ব্রাত্মণ,ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য নামে তিনটি শ্রেণির সৃষ্টি হয় । অনার্যরা শূদ্রবলে পরিচিত হয় ।

উপসংহার : বর্ণভেদ প্রথার শুরু হওয়ার পর আর্য সমাজের এই প্রথায় আরও নানা পরিবর্তন ঘটে । পরবর্তীকালে বর্ণ বা জাতিভেদপ্রথায় কঠোরতা বৃদ্ধি পায় । কিন্তু তা সত্ত্বেও বৈদিক সমাজের চারটি বর্ণের মধ্যে নানা ধরনের সামাজিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় । 



রবিবার, ১৭ জুলাই, ২০২২

মধ্যযুগে ইউরােপে ‘গিল্ড’ প্রতিষ্ঠার কারণ আলোচনা করো ।

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer মধ্যযুগে ইউরােপে গিল্ড প্রতিষ্ঠার কারণ আলোচনা করো modheyyuge europe gild protisthar karon alochona koro


উত্তর :  i) বিধান : মধ্যযুগে সর্বদা ব্যাবসাবাণিজ্যে নিরাপত্তার অভাব , অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি বণিকদের চিন্তিত করত । বাণিজ্যের নিরাপত্তা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ীরা নিজেদের ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করতে গিল্ড বা সংঘ গড়ে তুলেছিল । 
ii) বেহিনি কর আদায় রােধ : সামন্তপ্রভুরা বিভিন্ন অজুহাতে বণিকদের কাছ থেকে সর্বদা বিভিন্ন বেআইনি বা অন্যান্য কর আদায় করত । এ ধরনের কর আদায় প্রতিরােধ করতে ব্যবসায়ীরা গিল্ডের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল । 

iii) দস্যুদের মোকাবিলা : বাণিজ্যপথে দস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে বণিকরা নিজেদের খরচে ভাড়াটে রক্ষীবাহিন । নিয়ােগ করত । এই কাজ তদারকির উদ্দেশ্যে গিল্ড প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয় । 

iv) নগর ও বন্দরগুলিতে আধিপত্য : কুসেডের পরবর্তীকালে সামন্ততন্ত্রের দুর্বলতার সুযােগে বণিকরা নগর ও বন্দরগুলিতে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে । এই আধিপত্যকে আরও শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে বণিকরা গিল্ড প্রতিষ্ঠার প্রয়ােজন অনুভব করে । 

[        ] কারিগরদের গিল্প প্রতিষ্ঠারকারণ 

i) শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা : বণিকরা যাতে কারিগরদের পণ্যের মূল্য বা শ্রমের মজুরি কম না দিতে পারে তার জন্য কারিগররা ঐক্যবদ্ধ সংগঠন গড়ে তােলে ।

ii) প্রতিদ্বন্দ্বিতারােধ : কোনাে কোনাে কারিগর অন্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে নিজের পণ্য কম দামে বিক্রি করত । ফলে উভয় প্রতিপক্ষেরই ক্ষতি হত । এই প্রবণতা রােধ করে পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে রেষারেষি বন্ধের উদ্দেশ্যে গিল্ডের প্রতিষ্ঠা হয় । 

iii) কাঁচামালের জোগান অব্যাহত রাখা : সব কারিগরের পক্ষে সবসময় কাঁচামাল জোগাড় করে ওঠা সম্ভব হত না । তাই কাচামাল ও পণ্যের জোগান নিয়মিত রেখে উৎপাদন ব্যবস্থাকে সচল রাখতে গিল্ড গঠনের প্রয়ােজন হয় । 

iv) ক্রেতাস্বার্থ রক্ষা : অসাধু কারিগরদের হাত থেকে ক্রেতাদের রক্ষা করতে গিল্ড গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয় । অসাধু কারিগরদের চিহ্নিত করে যাতে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়, সে ব্যাপারে গিল্ড সতর্ক দৃষ্টি রাখত । 

উপসংহার : গিল্ডগুলি প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠার তাগিদটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল । কিন্তু গিল্ডের কর্মকর্তারা বাস্তবক্ষেত্রে শিল্পের চিরাচরিত প্রথার দিকে বেশি নজর দেওয়ার ফলে উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন আবিষ্কার ও উন্নত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার বিশেষভাবে ব্যাহত হয়েছিল ।





শনিবার, ১৬ জুলাই, ২০২২

গুপ্তযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে সামন্তপ্রথা উত্থানের পটভূমি লেখো ।

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer গুপ্তযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে সামন্তপ্রথা উত্থানের পটভূমি লেখো guptoyuge bharotiyo upomohadeshe samantaprotha uthaner potobhumi lekho


উত্তর : গুপ্তযুগে, বিশেষ করে আদিমধ্যযুগে ভারতের কৃষকসমাজ ভূমির মালিকানা হারিয়ে প্রভুর জমিতে শ্রমদানে বাধ্য হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন । ড , যাদব দেখিয়েছেন যে, আদি মধ্যযুগে ‘হালকর’ ‘বদ্ধহল’ প্রভৃতি শব্দগুলি কৃষকের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে । এর থেকে তিনি অনুমান করেন যে, সে যুগে কৃষকরা নিজস্ব অধিকার হারিয়ে প্রভুর জমিতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল । 
বাণিজ্যের অবনতি : সামন্ততন্ত্রের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল কৃষি অর্থনীতির ওপর বেশি নির্ভরতা এবং বাণিজ্যের অবনতি । ড . রামশরণ শর্মা ও ড .যাদব দেখিয়েছেন যে ,গুপ্তযুগে অগ্রহার ব্যবস্থার বিকাশের ফলে স্বনির্ভর গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিই মুখ্য হয়ে ওঠে । রােমান সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সঙ্গে রােমের সক্রিয় বাণিজ্যিক সম্পর্কও শেষ হয়ে যায় । ফলে ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় । 


নগরের অবক্ষয় : অগ্রহার প্রথাকে ভিত্তি করে গুপ্তযুগে উদ্ভূত নতুন ভূস্বামীরা কৃষি উৎপাদনে শ্রমের ওপর জোর দিলে শিল্প ও বাণিজ্য অবহেলিত হয় । ফলে নগরগুলির অবক্ষয় শুরু হয় । এসময় প্রাচীন নগরজীবনের অবক্ষয় এবং গ্রামজীবনের প্রসার সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ।  


সম্রাট ও কৃষকের মধ্যবর্তী শাসকগােষ্ঠী : ড . কোশাম্বীর মতে , খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের মধ্যে ভারতে সম্রাট তার অধীনস্থ বিভিন্ন স্থানীয় শাসকদের নিজেদের এলাকায় রাজস্ব আদায় ,শাসন পরিচালনা , আইনশৃঙ্খলা রক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে কিছু কিছু অধিকার দেন । উর্ধ্বতন সম্রাট কর্তৃক স্থানীয় শাসকদের এরূপ অধিকারদানকে ড . কোশাম্বী ‘ওপর থেকে সামন্ততন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছেন । ড . কোশাম্বীর মতে , খ্রিস্টীয় সপ্তম অষ্টম শতক নাগাদ সম্রাট ও কৃষকের মধ্যবর্তী স্তরে নতুন ভূম্যধিকারী গােষ্ঠীর উত্থান ঘটে যারা কৃষকদের ওপর বলপ্রয়ােগ করে কৃষি উৎপাদনকে সচল রাখত । ড . কোশাম্বী একে ‘নীচু থেকে সামন্ততন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছেন । 

গুপ্তযুগে সামন্ততন্ত্রের উত্থানে অগ্রহার প্রথার ভূমিকা : ভারতে গুপ্তযুগে সম্রাট এবং বিভিন্ন ধনী ব্যক্তি পুণ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা ব্রাত্মণদের নিষ্কর জমি দান করতেন । দানগ্রহীতা স্বয়ং প্রাপ্ত জমি বা গ্রামের রাজস্ব আদায় , আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, প্রশাসন ও বিচারকার্য পরিচালনা প্রভৃতি যাবতীয় বিষয়ের অধিকারী হতেন । এটি ‘অগ্রহার’ বা ‘ব্ৰন্থদেয়’ প্রথা নামে পরিচিত । এই প্রথার দ্বারা জমির যাবতীয় অধিকার চলে যেত দানগ্রহীতা অর্থাৎ জমির প্রাপকের হাতে । জমির প্রাপক এই দানপ্রাপ্ত জমির যাবতীয় রাজস্ব আদায় ও ভােগ করতেন । এই জমিতে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, বিচারকার্য পরিচালনা প্রভৃতি অধিকারও জমির প্রাপকের হাতে চলে যেত । দান প্রাপ্ত ভূমির ওপর অবস্থিত যাবতীয় সম্পদ , এমনকি ভূমির নীচে অবস্থিত খনিজ সম্পদেও জমির প্রাপকের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হত । এভাবে ভূমিদান ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশে স্থানীয় বিভিন্ন ভূস্বামীর আবির্ভাব ঘটে যা সামন্ততন্ত্রের ভিত্তি রচনা করে । 


উপসংহার : গুপ্তযুগে ভারতে যেসব সামন্ততান্ত্রিক উপাদান সক্রিয় হয়ে উঠেছিল সেগুলি পরিণামে সামন্ত প্রথার জন্ম দেয় । এ প্রসঙ্গে ‘অগ্রহার’ বা নিষ্কর জমিদান প্রথা গুপ্তযুগে সামন্তপ্রথা উদ্ভবের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল ।




শুক্রবার, ১৫ জুলাই, ২০২২

‘সামন্ততন্ত্র’ বলতে কী বােঝ ? ভারতের সামন্তপ্রথার বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো ।

একাদশ শ্রেণী ইতিহাস প্রশ্নোত্তর xi class 11 history Question answer সামন্ততন্ত্র বলতে কী বােঝ ভারতের সামন্তপ্রথার বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো samantatonro bolte ki bojho bharoter samantaprothar boishisto ullekh koro

উত্তর : ইংরেজি ‘ফিউডালিজম’ কথাটির বাংলা প্রতিশব্দ হল ‘সামন্ততন্ত্র’ বা ‘সামন্তপ্রথা’ । ‘ফিউডালিজম’ কথাটি এসেছে লাতিন শব্দ  ‘ফিওডালিস’ এবং ফরাসি শব্দ ‘ফেডালিতে থেকে । সামন্ততন্ত্র বলতে কী বােঝায় তা বিভিন্ন পণ্ডিত বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন ।

সাধারণ অর্থ : সাধারণভাবে সামন্ততন্ত্র বলতে এক বিশেষ ধরনের শাসনতান্ত্রিক কাঠামাে বােঝায় যেখানে কেন্দ্রীর শক্তির অধীনে বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির বিকাশ ঘটে এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসনের পরিবর্তে স্থানীয় ভূস্বামীদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীভূত হয়ে থাকে । অন্যভাবে বলা যায় ,ভূমি মালিকানা ও ভূমি নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক বিশেষ আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাই হল সামন্ততন্ত্র । 


বােলাভিয়ের - এর অভিমত : বােলাঁভিয়ের এর মতে , “সামন্ততন্ত্র হল সার্বভৌম অধিকারের বিভাজন যেখানে প্রশাসনকে খণ্ডিত ও বিকেন্দ্রীভূত করে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা , স্বাধীনতা ও সম্পত্তির সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয় ।” 


কার্ল মার্কসের অভিমত : কার্ল মার্কসের মতে , “স্বাধীনতাহীন শ্রমজীবী মানুষের দ্বারা বৃহৎ ভূসম্পত্তিতে কৃষি ও হস্তশিল্পজাত পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করার ব্যবস্থাই হল সামন্তব্যবস্থা ।”

পি ভি মায়ার্স - এর অভিমত : পি ভি মায়ার্স-এর মতে , সামন্ততন্ত্র হল এক বিশেষ সমাজ ও সরকার -পরিচালনা ব্যবস্থা যা বিশেষভাবে অনুশীলিত এক ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার ওপর ভিত্তিকরে গড়ে উঠেছে , যেটি মধ্যযুগের শেষ পর্বে ইউরােপে বিকাশ লাভ করেছিল এবং যা একাদশ , দ্বাদশ ও ত্রয়ােদশ শতকে ইউরােপে বিরাজ করছিল । 

এ কে নাজমুল করিম -এর অভিমত : অধ্যাপক এ কে নাজমুল করিম সামন্ততন্ত্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন যে , “সামন্তপ্রথা বলতে এমন একটি সমাজ ও সংস্কৃতিকে বােঝায় যেখানে ভূমিই হচ্ছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি ।”  


[           ] প্রাচীন ও মধ্যযুগে ইউরােপে সামন্ততান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামাে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে ।ইউরােপের কাঠামাের মতাে না হলেও প্রাচীন এবং মধ্যযুগের ভারতে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ ঘটে বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন । ভারতে সামন্তপ্রথার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় । যেমন 

স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামজীবন : সামন্ততান্ত্রিক সমাজের একটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য হল স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম্যজীবন । অর্থাৎ গ্রামে বসবাসকারী সকলের প্রয়ােজনীয় সামগ্রী গ্রামেই উৎপাদিত হত । ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের যুগে এদেশে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম জীবনের অস্তিত্ব ছিল ।


নগরায়ণের অভাব : কৃষি উৎপাদনের জন্য গ্রাম,কৃষক , খামারবাড়ি প্রভৃতি অপরিহার্য । নগরের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার সামন্ততন্ত্রের বিরােধী । ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের যুগেও গ্রামগুলির বিকাশ ঘটে এবং   নগরায়ণের বিকাশ ব্যাহত হয় । 

কৃষিভিত্তিক সমাজ : ভারতীয় সামন্তপ্রথায় সমাজ ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক । সমাজের নিম্নস্তরের বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল । কৃষিকাজকে কেন্দ্র করে দেশের গােটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হত । দেশে শিল্প ও বাণিজ্য ছিল গৌণ । শিল্প ও বাণিজ্য যেটুকু ছিল তা মূলত কৃষিপ্রসূত । 

ভূমি ও মানুষের সম্পর্ক : ভারতীয় সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদন ব্যবস্থার মূল উপকরণ ছিল ভূমি । ভূমিকে কেন্দ্র করেই সমগ্র কৃষিকাজ চলত । তাই স্বাভাবিকভাবেই মানুষ ভূমির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল । 

জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার অভাব : জমিতে কৃষক উৎপাদকের কাজে নিযুক্ত থাকলেও সেই জমিতে কৃষকের ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না । জমির প্রকৃত মালিক ছিল ভূস্বামী বা সামন্তপ্রভু এবং চূড়ান্ত মালিক ছিল রাষ্ট্র ।

সেচ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ : কৃষিকাজের জন্য কৃষকের জমিতে জলসেচের প্রয়ােজন ছিল । ভারতীয় সামন্ততন্ত্রে এই সেচ ব্যবস্থায় কৃষকের ব্যক্তিগত অধিকার ছিল না । তা রাষ্ট্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত । 

প্রভুর শ্রেষ্ঠত্ব : ভারতীয় সামন্ততন্ত্রে কৃষিজমির মালিকানা ছিল সামন্তপ্রভুর হাতে । তাই উৎপাদন ব্যবস্থা তথা সমগ্র অর্থনৈতিক কাঠামােতে স্বাভাবিকভাবেই প্রভুর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । 

উপসংহার : প্রাচীন ভারতে গুপ্তযুগে ভারতের সামন্ততান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি ক্রমশ স্পষ্ট হতে শুরু করে । তবে ভারতীয় সামন্ততন্ত্র কখনােই ইউরােপের সামন্ততন্ত্রের মতাে তীব্র ছিল না ।