উত্তর : গদ্যকাব্যের জগতে দণ্ডী, বাণ এবং সুবন্ধুরই একচ্ছত্র আধিপত্য । সুতরাং , এই কবিত্রয়ের পূর্বে গদ্যকাব্যের অস্তিত্ব থাকলেও এই তিন কবির লেখনীতে গদ্যকাব্যের যে সুবর্ণযুগ দেখা যায় , তা নিঃসন্দেহে পূর্বসূরিদের প্রতিভাকে ম্লান করে দিয়েছে এই তিন কবিকেই মূলত গদ্যকাব্যের পথিকৃৎ বলা যায় ।
“ এয়াে দণ্ডিপ্রবন্ধাশ্চ ত্ৰিষু লােকেষু বিশুতাঃ । ” — এই উক্তি থেকে স্পষ্টতই বােঝা যায়, দণ্ডী তিনখানি গ্রন্থের রচয়িতা । তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘ দশকুমারচরিতম্ ’ নামক গদ্যসাহিত্য এবং ‘ কাব্যাদর্শ ’ নামক অলংকারশাস্ত্র সুবিদিত । বহু মতানৈক্য থাকলেও শেষ পর্যন্ত ‘অবন্তিসুন্দরীকথা ’ নামক আখ্যায়িকাটিকে দণ্ডীর রচনা বলেই স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে ।
[ ] দণ্ডীর গদ্যকাব্যগুলির মধ্যে দশকুমারচরিতম ’- ই সর্বাধিক সমাদৃত । দশজন কুমারের জীবনচরিত অবলম্বন করে গ্রন্থখানি রচিত । এই গ্রন্থের কেন্দ্রীয় চরিত্র হল রাজকুমার রাজবাহন । মগধরাজ রাজহংস মালবরাজ মানসারের কাছে পরাজিত হয়ে সস্ত্রীক বিন্ধ্যগিরিতে বাস করতে থাকেন । সেইখানেই রাজবাহনের জন্ম । রাজার মন্ত্রীদের এবং বন্ধুর আরও ৯ জন কুমার রাজার নিকট প্রেরিত হয় এবং এই দশজন কুমারের লালনপালন ও শিক্ষাদীক্ষার দায়িত্ব রাজার ওপর বর্তায় । পরে যৌবনপ্রাপ্ত কুমারগণ দিগবিজয়ে যাত্রা করে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন । দীর্ঘকাল পরে তাঁদের পুনর্মিলন ঘটে এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ জীবনের ঘটনা ও অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন । এই কাহিনি নিয়েই ‘দশকুমারচরিতম্ । ‘
[ ] দশকুমারচরিতম্ নাম অনুসারে দশজন কুমারের বৃত্তান্ত আশা করা যায় । তন্মধ্যে আটটি উচ্ছ্বাসে আট জন কুমারের কাহিনি লিপিবদ্ধ আছে । পরে এই অসম্পূর্ণতা দূর করার জন্য পূর্বপীঠিকা এবং উত্তরপীঠিকা নামে দুটি অংশ মূলগ্রন্থের সঙ্গে যুক্ত করা হয় । বর্তমানে কাব্যটি যেভাবে পাওয়া যায়, তা মূলত তিনভাগে বিভক্ত— (১ ) পূর্বপীঠিকা , (২ ) উত্তরপীঠিকা এবং ( ৩ ) উপসংহার ।
কবির অপর একটি গদ্যকাব্য হল ‘ অবন্তিসুন্দরীকথা ' । সম্ভবতঃ অবন্তিসুন্দরীর কাহিনি ছিল দশকুমারচরিতে বর্ণিত মূল কাহিনির প্রারম্ভিক অংশ এবং পরবর্তীকালে উক্ত রচনাটি লুপ্ত হলে তার সারাংশ দশকুমারের পূর্বপীঠিকারূপে যুক্ত হয় ।
তাই পণ্ডিতদের অনুমান অবন্তিসুন্দরীর মূল কাহিনি বৃহৎকথার কোনাে গল্প থেকে সংগৃহীত । অবন্তিসুন্দরীতে সমুদ্রদত্ত ও কাদম্বরী এবং শৌনক ও বন্ধুমতীর আখ্যান বিবৃত । গদ্য রচয়িতা হিসেবে দণ্ডীর রচনায় সামঞ্জস্যবােধ আছে । শ্লেষ , অর্থহীন শব্দভাণ্ডার বা সুদীর্ঘ সমাসের দ্বারা অযথা তাঁর রচনা কোথাও ভারাক্রান্ত হয়নি । ছন্দের প্রত্যক্ষ যােগ না থাকলেও কাব্যে ছন্দগত দোলা , ধ্বনি, মাধুর্য এবং শব্দ ঝংকারের বৈচিত্র্য সুস্পষ্ট । তাঁর রচনা পড়ে “গদ্যং কবীনাং নিকষং বদন্তি ” —এই বােধ জাগে । তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট,ভাষা সরল , ললিত এবং সাবলীল । আর কাহিনিও চিত্তাকর্ষক । এই জন্যই বলা হয়— “ দণ্ডিনঃ পদলালিত্যম । ”
চরিত্রচিত্রণে কবি সিদ্ধহস্ত । মুখ্য চরিত্রগুলি তাে বটেই , এমনকি কামমঞ্জরী , বসুপালিত , মরীচি প্রভৃতি গৌণচরিত্রগুলিও তাঁর রচনায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে । তৎকালীন সমাজের নৈতিক অবনতি , যথা লােভ , অসাধুতা , প্রতারণা, গুপ্তপ্রেম, নারীহরণ , চুরি , জুয়াচুরি প্রভৃতি কুৎসিত দিকগুলিও ব্যক্ত করতে কবি কুণ্ঠিত হননি । কাল্পনিক আদর্শ সমাজচিত্র রচনা করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না । বাস্তব জীবনের প্রতি তাঁর দৃষ্টি অধিক নিবদ্ধ ছিল । দণ্ডীর কবিপ্রতিভা ছিল অনন্যসাধারণ । প্রাকৃতিক বর্ণনায়, মানবিক রূপ ও গুণ বর্ণনায় , ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ - পরিহাসে , বাচাতুর্যে এবং হাস্যরস সৃষ্টিতে তাঁর নৈপুণ্য অসাধারণ । তিনি ছিলেন একজন কুশলী কথাশিল্পী ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন